সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

পরিবর্তনের পাঁচালী

আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২২, ০০:৫০

কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছি। বিল দিব। আমার ঘাড়ের পেছনে তিন-চার জনের নিশ্বাস। আশপাশে জনক্ষেত্র। প্রতিদিন অগণিত মানুষ সেবা নিতে আসে, এমন একটা স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে এসেছি। জরুরি বিভাগে পাঁচটা ডেস্ক। কিন্তু কোনো লাইন নেই। যে যেভাবে পারছে, অন্যকে ডিঙিয়ে গিয়ে কাউন্টারে দাঁড়াচ্ছে। ভিড় থেকে একটু দূরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। উপায় না পেয়ে অন্য সবার পথেই অনেক কসরত করে ঠেলেঠুলে কাচের দেওয়ালের সামনে পৌঁছেছি। কাউন্টারের ওপাশে সেবাদাতাদের অবস্থাও তথৈবচ। এপাশের চিলচিত্কারে কিছু শুনছেন বলে মনে হয় না। অনুমানের ওপর কাগজ দেখে সেবা দিচ্ছেন।

কাজ শেষে প্রতিষ্ঠান প্রধানের রুমে গেলাম। তিনি আবার আমার শিক্ষাজীবনের কলেজের অনেক সিনিয়র। আগেও কথা হয়েছে। খুব আন্তরিকতা নিয়ে। আজ এই কথা, সেই কথা শেষে বললাম, স্যার, আপনার ইমার্জেন্সি কাউন্টারে একটা কাউন্টার কিউ ম্যানেজমেন্ট মেশিন বসালে মানুষের উপকার হতো। খরচ খুব বেশি হবে না এতে। তবে এতে সেবা দেওয়া সহজ হতো। কাজের মানও বৃদ্ধি পেত।

তিনি আমার দিকে একটু বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। তারপর বললেন, দেখো, বলা সহজ। কিন্তু এখানে অনেক দরিদ্র লোক আসে। অধিকাংশই লেখাপড়া জানেন না। ওরা সার্ভিস নেবে কীভাবে? উলটো কিউ মেশিনের সার্ভিস দেওয়ার জন্য চার জন অতিরিক্ত লোক লাগবে।

আমি বললাম, আইসিডিডিআর,বিসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে সিকিউএম মেশিন আছে। নানা ধরনের অসংখ্য মানুষ নির্বিঘ্নে সেবা নিচ্ছেন। তাছাড়া আপনার এখানে তো তিন-চার জন আনসার দেখলাম, মানুষের ভিড় ঠেলেই যাচ্ছে। ওদেরও কাজে লাগানো যায়।

আমার কথা তার খুব বেশি পছন্দ হলো না, বোঝা গেল। তিনি কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গেলেন। দিন দুই আগে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ ঘুরে এসেছেন তিনি। সেখানে সবকিছুই সুন্দর। কিন্তু সুন্দর সেবা দেখে এলেই হবে না। আমাদের দেশে সেই সেবা দেওয়ার সুযোগ নেই, আমাকে বোঝালেন।

আমিও বুঝলাম। মানুষ খুব সহজে পরিবর্তন মেনে নিতে চায় না। ধরুন, আপনি সিগারেট খান। হঠাৎ কি এটা খাওয়া বন্ধ করে দিতে পারবেন? অথবা আপনি কি যখন-তখন বাসা, চাকরি বদলের কথা ভাবতে পারেন? এমনকি শুধু কর্মস্থল পরিবর্তন? খুব ব্যতিক্রম ছাড়া উত্তরটা হবে—না।

এই যে পরিবর্তন মানুষ মেনে নিতে চায় না, এর রহস্য কী? এর রহস্য আছে আমাদের মস্তিষ্কে। আমাদের ‘রেপটিলিয়ান ব্রেইন’-এর মধ্যে। আবার মস্তিষ্কের ভেতর পিটুইটরি গ্ল্যান্ডের একটু নিচে একটা অংশ আছে। নাম আমিগড্যালা (Amygdala)। আমিগড্যালা আমাদের চারপাশের বিভিন্ন উৎস থেকে ভয়-উদ্বেগ-শঙ্কার অনুভূতি জাগ্রত করে। এই অনুভূতিটুকু একেবারে প্রস্তরযুগ থেকেই আমরা বহন করছি। লক্ষ করে দেখবেন, আপনার ছোট্ট ছয় মাসের বাচ্চাটাও বিছানা থেকে কোলে তোলার সময় ঘাড় শক্ত করে রাখে। আপনার হাত বা কাপড়ে শক্ত করে ধরার চেষ্টা করে। কারণ, সে বুঝতে পারে কিছু একটা পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।

এই অনুভূতিটা আমাদের দৈনন্দিন সব কাজেই সংক্রমিত হয়। আপনার অফিসে প্রথম যখন টাইপরাইটারের জায়গায় কম্পিউটার বসানো হলো, তখন অধিকাংশ কর্মচারীর ভেতর একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তারা ভাবছিল, এই যন্ত্র কি আমরা চালাতে পারব? চালাতে যদি না পারি, তাহলে আমাদের চাকরি কি থাকবে? চাকরি না থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? এই যন্ত্র তো একাই অনেক কাজ করে ফেলবে। তখন আমাদের কি আর প্রয়োজন হবে? এই রকম হাজারো নিরাপত্তাহীনতা আর ভয়ের দুঃস্বপ্ন তাদের তাড়া করত।

এভাবে তারা নিজেদের নিয়ে রাজ্যের ভয়, শঙ্কায় যে কোনো প্রযুক্তিকে প্রতিপক্ষ ভাবতে থাকে। আমাদের মস্তিষ্ক এভাবে কিছু পূর্বনির্ধারিত ধারণা, অভিজ্ঞতা গেঁথে রাখে। নতুন কিছু এলেই সেই পূর্বধারণা বা চিন্তা আমাদের মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়। এটা একটা অটোপাইলটের মতো। নতুন কিছু ঘটতে যাচ্ছে ভাবা মাত্রই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। নিজের বিদ্যমান আরামদায়ক অনুকূল পরিস্থিতি (কমফোর্ট জোন) রক্ষার জন্য এর বিপরীত যুক্তি সাজাতে থাকে। আর আমরাও সেই স্রোতে গা ভাসাই। যে কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে প্রতিহত করি। এই মানসিক অবস্থা আমাদের অতীতে আটকে রাখে।

এখন, এই মানসিক অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী? ডেভিড গ্লিচার নামে নিউ ইয়র্কের এডেলফি ইউনিভার্সিটির একজন সহযোগী অধ্যাপক একটা উপায় আবিষ্কার করেন। তার তত্ত্বটি পরে একটু পরিমার্জিত হয়ে নিম্নের রূপ ধারণ করে- C = D x V x F > R. সূত্রটি এইরকম@Change = Dissatisfaction x Vision x First Concrete Steps > Resistance. এই তত্ত্বটিকে একটু ব্যাখ্যা করা যায়। পরিবর্তন সূচিত করার জন্য আমাদের প্রথমে মানসিক বাধাকে অতিক্রম করতে হবে। মানসিক বাধা অতিক্রমের জন্য আমাদের অসন্তোষ চিহ্নিত করতে হবে, স্বপ্ন জাগ্রত করতে হবে এবং পরিবর্তনের জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। ক) বর্তমান অবস্থা নিয়ে অসন্তোষের ক্ষেত্র চিহ্নিত করা (Dissatisfaction)—পরিবর্তন করতে চাইলে প্রথমে চলমান অবস্থার ত্রুটি আর অসন্তোষগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এই ব্যবস্থা কীভাবে আর্থিক ক্ষতি আর সেবার মান কমিয়ে দিচ্ছে, তা বোঝাতে হবে। যেমন : শুরুতে আমার অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বলা যায়, কর্তৃপক্ষকে দেখাতে হবে যে অসংখ্য মানুষ সেবা নিতে আসছেন। কিন্তু তারা কেউই সহজে সেবা নিতে পারছেন না। সেবাদাতারাও ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।

খ) প্রস্তাবিত পরিবর্তনের ফলে ধনাত্মক পরিবর্তনের স্বপ্ন জাগ্রত করা (Vision)—প্রস্তাবিত পরিবর্তন করে অন্য কোথাও ভালো উদাহরণ তৈরি হয়ে থাকলে তা দেখাতে হবে। এর ফলে সবাই কীভাবে আরো সহজে কম পরিশ্রমে কাজ সমাধা করতে পারবেন, তার উদাহরণ দিতে হবে। গ) স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য দৃশ্যমান পরিমাপযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া। (First Concrete Steps)—যারা বাধা দেয়, তাদের মধ্য থেকে কিছু কর্মীকে পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। যেমন :মেশিনটা কোথায় বসবে, বিদ্যুতের সংযোগটা কোথায় দিলে ভালো হয়, এরকম। এভাবে পর্যায়ক্রমে সবাইকে নিয়ে আমরা পরিবর্তনের বিরোধী মনোভাবকে পরাজিত করতে পারি। এ তো গেল প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তনের দাওয়াই। কিন্তু ব্যক্তির এমিগড্যালার ভয়ের সংস্কৃতি দূর হবে কীভাবে? সেই পথ বাতলে দিয়েছেন রবার্ট মোরার।

রবার্ট মোরার বলছেন, কোনো অবস্থার পরিবর্তন করতে চাইলে খুব ছোট পদক্ষেপ দিয়ে এগোতে হবে। এটাকে তিনি জাপানের বিখ্যাত ‘কাইজেন’ পদ্ধতির সঙ্গে মিলিয়ে বর্ণনা করছেন। যেমন ধরুন, আপনি চিনিসহ পাঁচ কাপ চা খান প্রতিদিন। আপনি চাইছেন, চায়ের সঙ্গে চিনি খাওয়া কমিয়ে দেবেন। আপনি যদি কাল থেকে একেবারে চিনি বন্ধ করে দেন, তাহলে আপনার ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৯৫ ভাগ। কিন্তু আপনি ঠিক করলেন, আগামী এক সপ্তাহ এক কাপ চায়ে চিনি খাবেন না। এর পরের সপ্তাহে দুই কাপ। পর্যায়ক্রমে এবং সুবিধামতো পাঁচ কাপেই চিনি কমিয়ে দেবেন। এভাবে একদিন ঠিকই দেখবেন, আপনার চায়ে চিনি অপাঙেক্তয় লাগছে। এভাবে পরিবর্তন করতে চাইলে একজন সহযোগীকে সাক্ষী রাখা লক্ষ্য অর্জনকে সহজ করে দিতে পারে। আপনি হয়তো খুব কাছের একজনের সঙ্গে আপনার চিনিবিরোধী অভিযানের তথ্য দিয়ে রাখলেন। ভুল করে অথবা ইচ্ছায় এরপর চিনি খেতে চাইলেও তিনি আপনাকে অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। ফলে আপনি আর চিনি খেতে পারবেন না।

এভাবে খুব ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়ে আমরা বৃহত্ পরিবর্তনের দিকে যেতে পারি। জয় করতে পারি এমিগড্যালা সংক্রমিত বাধা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গল্পকার

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন