খাদ্যে ভেজাল বাংলাদেশের এক জাতীয় অভিশাপের নাম। ইহা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকিস্বরূপ। শুধু মানবখাদ্যেই যে ভেজাল দেওয়া হয়, তাহা নহে। ইদানীং পশুখাদ্যেও ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা বাড়িয়া চলিয়াছে। প্রকারান্তরে ইহাও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। এই বিষয়টি লইয়া এখন আমাদের নূতন করিয়া ভাবিতে হইবে। গতকাল ইত্তেফাকে প্রকাশিত এক খবরে বলা হইয়াছে যে, বগুড়ার শেরপুরে পশুখাদ্য তৈরির প্রধান উপকরণ ডিওআরবিতে (ডিওয়েল্ড রাইচ ব্র্যান) মিশানো হইতেছে কেমিক্যাল। দ্বিগুণ লাভের আশায় পচা ডিওআরবি ও রাইচ ব্র্যানের সহিত মিশানো হইতেছে মেয়াদ উত্তীর্ণ আটা, বালিমাটি, টাইলসের একপ্রকার সিরামিকসের ধুলা ইত্যাদি। ইহার পর নামিদামি কোম্পানির সিল দেওয়া বস্তায় ভরিয়া তাহা বাজারজাত করা হইতেছে। এই সকল ভেজাল খাদ্য খাইয়া বিভিন্ন প্রকার গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, মাছ ইত্যাদি নানা রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হইতেছে, কখনো কখনো মারাও যাইতেছে। ইহাতে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছেন মারাত্মকভাবে। আর তাহার মাংস ও দুগ্ধ ভক্ষণ করিয়া মানুষ আক্রান্ত হইতেছে নানা অসুখবিসুখে।
দেশের বিভিন্ন বাজারে পোলট্রি ফিড, কুড়া, ভুসি, খৈল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের কারণে হাজার হাজার মৎস্য, দুগ্ধ ও হাঁস-মুরগির খামার আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। এই সকল অসাধু ব্যবসায়ী কুড়ার সহিত কাঠের গুঁড়া, ধানের তুষ, আটা; খৈলের সহিত কালো পোড়া মাটি, পোড়া মবিল ও দালানের মেঝেতে ব্যবহৃত কালো রং ইত্যাদি মিশাইয়া বিক্রয় করিতেছে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে ভালো কোম্পানিগুলিরও সুনাম ক্ষুণ্ন হইতেছে। এমনকি পশুপাখির চিকিৎসার জন্য যে ঔষধ বিক্রয় হইতেছে, তাহারও অধিকাংশ ভেজাল ও নিম্নমানের। ফলে খামারিরা যাইবেন কোথায়? ভেজাল খাদ্যের কারণে আমরা কিডনি বিকলাঙ্গ, ক্যানসার, আলসার, হার্ট অ্যাটাক, ব্রেন স্ট্রোকসহ নানা রকম ঘাতক ব্যাধির কবলে পড়িয়া ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর পথযাত্রী হইতেছি। পশুখাদ্যে ভেজালের কারণেও আমাদের অবস্থা শোচনীয়। মাছ, পশু ও হাঁস-মুরগির যে ফিড তৈরি করা হয়, তাহা অনেক সময় উৎপাদন করা হয় চামড়াশিল্পের বর্জ্য দিয়া। এই সকল বর্জ্যে রহিয়াছে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম, যাহা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এই সকল মাছ, হাঁস-মুরগি ও পশুর মাংস রান্না করিলেও এই ক্রোমিয়াম নষ্ট হয় না। ইহার তাপ সহনীয় ক্ষমতা ২ হাজার ৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আর রান্না করা হয় ১০০ হইতে ১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে। সুতরাং মানব ও পশুখাদ্য—যাহাই হউক না কেন, তাহাতে ভেজালের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার ও সচেতন হইতে হইবে। এই ব্যাপারে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করিতে হইবে।
যে কোনো পশুখাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমোদন লইতে হয়। কারখানা স্থাপনে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ অন্যান্য দপ্তরেরও অনুমোদন লাগে; কিন্তু অসৎ ব্যবসায়ীরা এই সকল নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করিতেছেন না। ভেজাল ও মানহীন পশুখাদ্য তৈরির কারখানাগুলি মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে শনাক্ত ও সিলগালা করা হইতেছে এবং পোলট্রি ফিড কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে আদায় করা হইতেছে জরিমানা; কিন্তু কিছুদিন না যাইতেই তাহা আবার গড়িয়া উঠিতেছে কীভাবে? পশুখাদ্যে ভেজাল মিশানোর মূল উদ্দেশ্য হইল ঐ পণ্যের ওজন বৃদ্ধি করা এবং ইহার মাধ্যমে রাতারাতি আঙুল ফুলিয়া কলাগাছ বনিয়া যাওয়া। লোভ আর কাহাকে বলে! অবশ্য মানুষ লোভে পড়িলে অনেক সময় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে। ভেজাল পশুখাদ্যের কারবারিরাও এই প্রকৃতির জঘন্য মানুষ এবং তাহাদের সিন্ডিকেট যে করিয়াই হউক ভাঙিয়া দিতে হইবে। জেল-জরিমানা, কারখানা সিলগালার পাশাপাশি এই ধরনের কারখানা যাহাতে আর গড়িয়া উঠিতে না পারে, তাহার প্রতি খেয়াল রাখিতে হইবে। গবাদি পশুর খাদ্যে সিসা, অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাকটেরিয়া, কীটনাশক বা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক অন্যান্য উপাদান আছে কি না—তাহা খুঁজিয়া বাহির করিবার জন্য মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশ রহিয়াছে। ভেজালের মাধ্যমে মানুষ ও পশু-পাখির এই নীরব হত্যাকাণ্ড বন্ধে এই নির্দেশেরও প্রতিপালন জরুরি।