মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অশ্লীল ভিডিও কলে ফাঁসিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে যেভাবে

আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:১০

কলকাতার বাসিন্দা এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের বাড়িতে সেদিন কয়েকজন অতিথি এসেছিলেন। স্থানীয় সময় রাত ৯টা ৩৯ থেকে দুই মিনিটের মধ্যে একটা অচেনা নম্বর থেকে পর পর ভিডিও কল আসছিল ভদ্রলোকের হোয়াটস্অ্যাপ নম্বরে। অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় প্রথমে খেয়াল করেন নি তিনি, তাই ফোন ধরতেও পারেন নি।

আবার ৯টা ৪২ মিনিটে 'হাই' বলে একটা মেসেজ আসে ভদ্রলোকের হোয়াটস্অ্যাপে। কল আসছিল যে নম্বর থেকে, এই মেসেজটাও একই নম্বর থেকে আসা। এবারে খেয়াল করেন তিনি। উত্তরে লেখেন, 'আমি কি আপনাকে চিনি?'

ফাঁদে পড়তে চলেছিলেন এক নেতা। কলকাতার বাসিন্দা সুপ্রতিষ্ঠিত ওই ব্যক্তির বুঝতে অসুবিধা হয় নি, যে অশ্লীল চ্যাটের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে তাকে। তিনি সেই প্রলোভনে অবশ্য পা দেন নি।

অশ্লীল চ্যাটের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে তাকে।

তবে ভারতের বহু মানুষ যে ভুলটা করছেন, তা হল অচেনা নম্বর থেকে আসা হোয়াটস্অ্যাপ বা ফেসবুক মেসেঞ্জারের ভিডিও কলটা রিসিভ করে ফেলে। যে ভুলটা করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস দলের বর্ষীয়ান নেতা ও হুগলী জেলার চুঁচুড়া থেকে ১৫ বছরের বিধায়ক অসিত মজুমদার।

সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখে তার মোবাইলে একটা অচেনা নম্বর থেকে ভিডিও কল আসে। তিনি কলটা রিসিভ করে নিয়েছিলেন। মজুমদার সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, কলটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্তে এক নারীর ভিডিও দেখা যায় যিনি তার পোশাক খুলছিলেন। মুহূর্তেই বুঝে যাই যে এটা একটা ফাঁদ। কলটা কেটে দিই।'

তৃণমূল কংগ্রেস দলের বর্ষীয়ান নেতা ও হুগলী জেলার চুঁচুড়া থেকে ১৫ বছরের বিধায়ক অসিত মজুমদার।

সেদিন পর পর বেশ কয়েকবার ওই একই নম্বর থেকে ভিডিও কল আসে, আর ধরেননি তিনি। পরের দিন অন্য একটা নম্বর থেকে ফোন আসে। বলা হয় দিল্লি পুলিশ থেকে ফোন করা হচ্ছে এবং তাদের কাছে মজুমদারেরর সেক্স চ্যাটের ভিডিও আছে, যেটা তারা ভাইরাল করে দেবেন।

'আমি তাদের নম্রভাবেই বলি যে হোয়াটস্অ্যাপে কল না করে সাধারণ কল করুন। তারা বারে বারে একই হুমকি দিতে থাকে। তখন আমি বলি, যিনি ফোনটা করছেন, তিনি যে পুলিশ অফিসার নন, সেটা আমি বুঝে গেছি, আমাকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করে লাভ হবে না,' সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন মজুমদার। কল ডিটেল তিনি পুলিশের কাছে জমা দিয়েছেন। 

'যেহেতু আপনি ভিডিও কল রিসিভ করেছেন, তাই আপনার মুখটাও অপর প্রান্তে দেখা যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেও আপনি যদি কলটা কেটে দেন, অন্য প্রান্তে কাজ হাসিল হয়ে গেছে,' বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গের সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিশেষ সরকারী কৌঁসুলি বিভাস চ্যাটার্জী।

পশ্চিমবঙ্গের সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিশেষ সরকারী কৌঁসুলি বিভাস চ্যাটার্জী।

চ্যাটার্জী জানান, যিনি কলটা রিসিভ করলেন, তার মুখ তো চলে এলো। আর অন্যদিকে তো পর্ন ভিডিওর অভিনেত্রী আছেন। এই দুইটিকে এডিট করে একটা এমএমএস বানাচ্ছে যা দেখে মনে হবে সত্যিই ওই ব্যক্তি অশ্লীল ভিডিও চ্যাট করছিলেন। তারপর সেটা এই ব্যক্তিকে পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে যে টাকা না দিলে এই ভিডিও পরিবার, বন্ধু, অফিসের সহকর্মীদের পাঠিয়ে দেওয়া হবে।'

সামাজিক দুর্নামের ভয়ে বহু মানুষ টাকা দিতে শুরু করছেন ওই ব্ল্যাকমেইলারদের। আর একবার যদি তাদের কথায় টাকা দিয়ে ফেলেন কেউ, তার কবল থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন বলে মন্তব্য করেছেন সাইবার সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্তর।

সামাজিক দুর্নামের ভয়ে বহু মানুষ টাকা দিতে শুরু করছেন ওই ব্ল্যাকমেইলারদের।

বিশেষজ্ঞরা এই সাইবার অপরাধের নাম দিয়েছেন সেক্সটরশান বা সেক্স চ্যাটের নাম করে এক্সটরশান, অর্থাৎ ব্ল্যাকমেইল করা। এই অপরাধের শিকার হচ্ছেন মূলত মধ্যবয়সী প্রতিষ্ঠিত পুরুষরা। রাজস্থানের ভরতপুর জেলা থেকে বছর তিনেক আগে এই অপরাধের সূচনা হয়। তাই পুলিশ আর সাইবার বিশেষজ্ঞদের ভাষায় এটা 'ভরতপুর গ্যাং' অপারেশন।

যেমনটা সাইবার অপরাধের জগতে একটা অতি পরিচিত নাম হয়ে গেছে জামতাড়া গ্যাং। কলকাতার এই সময় পত্রিকার সহকারী সম্পাদক চিত্রদীপ চক্রবর্তী একটা গবেষণাধর্মী বই লিখছেন এই সাইবার অপরাধ নিয়ে। তিনি ভরতপুরেও গেছেন।

পুলিশ আর সাইবার বিশেষজ্ঞদের ভাষায় এটা 'ভরতপুর গ্যাং' অপারেশন।

তার কথায়, 'দুই গ্রাম বুদলি আর ঝাঞ্জর থেকে এই অপারেশন শুরু হয় ২০১৯ সালে। আমি গিয়েছিলাম ওখানে। যারা এই কাজটা শুরু করে, তারা কিন্তু বেশি শিক্ষিত নয়। অনেকে তো এই অপরাধটা পারিবারিক কাজ হিসাবেই চালায়। আর ওরা কাজটা শুরু করেছিল একটু অন্য ভাবে। তখনও এটাকে সেক্সটরশান বলা হত না।'

চিত্রদীপ চক্রবর্তী জানান, প্রথমে ওরা নানা কায়দায় হোয়াটস্অ্যাপ নম্বর যোগাড় করত। সেখান থেকে ডিপিটা (প্রোফাইল ছবি) নিয়ে ওরা কোনও পর্ন ছবিতে সেটা সেট করে ব্ল্যাকমেইলটা করত তখন। ওরা দুইটি সফটওয়্যার ব্যবহার করত। পরে যখন বহু মানুষ এভাবে প্রতারিত হয়ে ডিপি বদলে ফুল, গাছ, প্রাকৃতিক দৃশ্য লাগাতে শুরু করেন, তখন ওরাও কৌশল পাল্টায় আর এই এখন যেটা চলছে, সেভাবে ভিডিও কল করে প্রতারণাটা করছে।

তবে এখন আর শুধু ভরতপুর থেকেই যে অপরাধটা চলে ,তা নয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে এরা। ভরতপুর গ্যাঙের বেশ কয়েকজন সদস্য ধরাও পড়েছেন।

চক্রবর্তী বলেন, 'এরকমই একজন ধৃত পুলিশকে জানিয়েছিল, সে একাই ১১ কোটি টাকা ব্ল্যাকমেইল করে রোজগার করেছে। তাহলে চিন্তা করুন কত কোটি টাকা এই ভরতপুর গ্যাং তুলছে! 

সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত বিশেষ সরকারী কৌঁসুলি বিভাস চ্যাটার্জী বলেন, 'এরা যে বিষয়টার জেরে অপরাধটা চালিয়ে যেতে পারছে, তা হলো মানুষের সম্মানহানির ভয়। এরা শিকার খোঁজে সমাজে কিছুটা প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে, যে অংশটা সামাজিক সম্মান বাঁচানোর জন্য পরিবার বা পুলিশকে জানাতে হয়তো ভয় পাবেন। তাই খুব কম সংখ্যায় সেক্সটরশানের ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্টেড হচ্ছে।'

অপরাধীরা টর ব্রাউজার ব্যবহার করে, যার আইপি অ্যাড্রেস যোগাড় করা একরকম দু:সাধ্য।

চ্যাটার্জীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, যদি বা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অপরাধীদের ধরা গেল, এরা জানে প্রমাণ যোগাড় করে চার্জশীট সময় মতো দেওয়া সম্ভব নয় এই অপরাধের ক্ষেত্রে। তাই কয়েকমাস পরেই জামিন হয়ে যায়।

তিনি বলছেন, এইজন্যই ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে টাকা না দিয়ে পুলিশকে জানাতে, যাতে যে অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটার সূত্র ধরে অপরাধীদের খোঁজ পাওয়া যায়। পুলিশের কাছে না যাওয়ার ফলে ঠিক কতজন সেক্সটরশানের শিকার হয়েছেন, তার সংখ্যা কারও কাছেই নেই।

তবে সাইবার সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, কলকাতায় সংখ্যাটা মোটামুটিভাবে হাজার খানেক ছিল ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু এখন সেটা হাজার দশেকের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে অবাক হব না। পুলিশকে জানানো তো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, কিন্তু কিছু সাবধানতা নিজেদেরও নেওয়া দরকার।

সাইবার সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ সেনগুপ্ত পরামর্শ দিয়েছেন, 'এক তো অচেনা নম্বর থেকে আসা কোনও রকম হোয়াটস্অ্যাপ ভিডিও কল অথবা অপরিচিত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে আসা মেসেঞ্জার কল রিসিভ করবেন না। তবে অনেক সময়েই কাজের মধ্যে অন্যমনস্ক থাকি আমরা, তাই হয়তো খেয়াল না করেই কলটা রিসিভ করে ফেলি। সেই সুযোগে যাতে অপরাধ না করতে পারে ভরতপুর গ্যাং, তাই মোবাইলের সেলফি ক্যামেরার ওপরে একটা স্টিকার লাগিয়ে রাখুন। কোনোভাবেই যাতে আপনার মুখ না দেখা যায়।' 

নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে যে কোটি কোটি টাকা লুট করছে এই সেক্সটরশান গ্যাঙ, তা নয়। এরা অনেককে আত্মহত্যা করতেও বাধ্য করেছে। টাকা দিতে গিয়ে ধারকর্জ করা, বা পরিবার, সমাজের সামনে সম্মানহানি থেকে বাঁচতে পশ্চিমবঙ্গেই গত দুইবছরে অন্তত ছয়জন এই গ্যাঙের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন, এমনটা জানা যাচ্ছে সংবাদপত্রগুলির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে।

সুত্রঃ বিবিসি

ইত্তেফাক/ডিএস