সামাজিকীকরণ একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এ প্রক্রিয়া প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই চলমান থাকে। এ প্রক্রিয়ায় একটি শিশু তার মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, সহপাঠী, খেলার সাথি, শিক্ষক ও গুরুজনদের আচার-আচরণ ও গুণাবলির দ্বারা প্রভাবিত হয়। শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হওয়ায় তাদের গুণাবলি অনুসরণ করে চলার প্রবণতা শিশুর মাঝে তৈরি হয়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় শিশুরা সামাজিক মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার সমস্ত উপাদানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে থাকে। সমবয়সী সঙ্গী, সহপাঠী আর অন্যান্য শিশুর সঙ্গে মেলামেশার ফলে শিশুদের মাঝে সহমর্মিতা, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব আর মিলেমিশে থাকার মনোভাব তৈরি হয়। কোনো খেলার সাথি আঘাত পেলে তার ব্যথা নিরাময়ে সেবা করা, তাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া এসবের মধ্য দিয়ে তারা দায়বদ্ধতা আর সহযোগিতার গুণ রপ্ত করে। শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হওয়ায় সহজেই অন্য শিশুর গুণাবলি অনুসরণ করতে শিখে যায়। খেলাধুলা আর সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে তারা বাস্তব জগৎকে উপভোগ করতে শুরু করে। পরবর্তীকালে প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যের কারণেই তারা সামাজিক মানুষে পরিণত হওয়ার সুযোগ পায়। সমাজের মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, বিপদাপদ তাকে অনুভূতিপ্রবণ করে তোলে।
শিশুর সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ সম্পন্ন হলে তারা বাবা-মা আর গুরুজনদের অনুগত থাকে এবং তাঁদের শ্রদ্ধা করতে শেখে। তাঁদের নির্দেশিত পথে চালিত হয়। বর্তমান যুগ প্রযুক্তিনির্ভর। আর প্রযুক্তির সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা আর নির্ভরশীলতায় শিশুদের সামাজিকীকরণে সৃষ্টি হয়েছে প্রতিবন্ধকতার। পরিবারে বাবা-মা ও অন্যান্য সদস্যের ব্যস্ততার কারণে শিশুর সঙ্গী হয়ে উঠছে স্মার্ট ফোন। শিশুরাও নিঃসঙ্গতা কাটাতে ব্যবহার করছে। অনেক অভিভাবক শিশুদের হাতে স্মার্ট ফোন দিয়ে তাকে খাবার খাওয়ান, কখনো তাদেরকে ব্যস্ত রাখেন। একসময় স্মার্ট ফোনের প্রতি শিশুদের আসক্তি জন্মে। স্মার্ট ফোন ছাড়া খাবার খেতে চায় না, পড়তে চায় না। অনেক শিশুকে পড়তে বসতে বললে শর্ত জুড়ে দেয় ফোন হাতে দিলে পড়তে বসবে। কিন্তু স্মার্ট ফোনের কন্টেন্ট কিংবা গেমসগুলো শিশুদের কেবল অবাস্তব জগতের সঙ্গে পরিচিত করায়। ফোনের গেমসগুলো স্তরে স্তরে ভাগ করা থাকায় শিশুরা এক স্তর থেকে অন্য স্তরে পৌঁছাতে মরিয়া হয়ে ওঠে, তারা উত্তেজিত হতে শুরু করে এবং যে কারণেই তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ ইন্টারনেটনির্ভর কন্টেন্ট অশ্লীলতায় জর্জরিত আর ইন্টারনেট যেহেতু অবাধ বিচরণের পথকে উন্মুক্ত করে, কাজেই শিশুরাও ঐসব কন্টেন্টের সঙ্গে পরিচিত হয়। যার ফলে তাদের মূল্যবোধ গঠনে বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং নেতিবাচক কৌতূহলের উদ্রেক ঘটে। দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার উপাদানগুলো হয় উপেক্ষিত। দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ফোনের সংস্পর্শে থাকায় শিশুদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, মস্তিষ্কক্রিয়ায় গোলযোগ, টিউমার, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, নিদ্রাহীনতাসহ নানাবিধ জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। একজন কুমারকে কাদামাটি দিলে তিনি যেমন তা দিয়ে হাঁড়ি-পাতিল, ফুলদানি যে কোনো কিছু বানিয়ে ফেলতে পারেন; তেমনি শিশুরাও কাদামাটির মতোই আমরা তাদের যে ধাঁচে লালনপালন করব সেভাবেই সে শিশু বড় হতে থাকবে। কাজেই অভিভাবক হিসেবে শিশুর সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে আমাদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। স্মার্ট ফোন যেন তাদের আসক্তির কারণ না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়