শরীরের অনেক সমস্যার চটজলদি সমাধানের জন্য বাজারে অনেক পণ্য পাওয়া যায়। ডিটক্সের নামে এমন মুশকিল আসান কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে মোটেই কার্যকর নয়। বরং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাই শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞাপন জগতের কথা বিশ্বাস করলে মনে হবে, আমাদের শরীর যেন একটা টক্সিক টাইম বোমা। ডিটক্সই যেন একমাত্র মুশকিল আসান। ডিটক্সের অর্থ শরীরকে ক্ষতিকারক পদার্থ মুক্ত করা।
এর পেছনে যে ধারণা কাজ করছে সেটা হলো, দৈনন্দিন জীবনে আমাদের শরীরে বিশাল মাত্রায় ক্ষতিকারক পদার্থ প্রবেশ করে। মেটাবোলিজম বা বিপাকের ফলে বর্জ্যও সৃষ্টি হয়। ধাতুর প্রক্রিয়াকরণের সময় যে বর্জ্য সৃষ্টি হয়, শরীরের মধ্যেও তেমন পদার্থ জমা হয় বলে সুসানে উমবাখ নামের এক পুষ্টিবিদ জানালেন।
সুসানে উমবাখের মতে, শরীরের মধ্যেও স্ল্যাগ সৃষ্টি হয়। প্রবল উত্তাপের কারণে এমন অবাঞ্ছিত অবশিষ্টাংশ দেখা দেয়। কোলনের মতো শরীরের যে অংশ ডিটক্সিফিকেশন করে, চিমনির পাইপের মতো সেটিও স্ল্যাগমুক্ত করা প্রয়োজন বলে একটা ধারণা চালু রয়েছে।
কিন্তু ঘটনা হলো, বিজ্ঞানের শিক্ষা অনুযায়ী আমাদের শরীরে আদৌ কোনো স্ল্যাগ নেই৷ অর্থাৎ, স্ল্যাগ দূর করারও কোনো প্রয়োজন নেই। স্বাস্থ্যবান মানুষের শরীরে ডিটক্সিফিকেশনের অঙ্গ হলো লিভার, কিডনি ও কোলোন। সেগুলো নির্ভরযোগ্যভাবে শরীরকে বিষমুক্ত করে।
সুসানে উমবাখ মনে করেন, যথেষ্ট হাঁটাচলা করা, যথেষ্ট পরিমাণ তরল পান করাও অবশ্যই জরুরি। কারণ শরীর থেকে কোনো পদার্থ বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে তরলই সেরা মাধ্যম। খোলা আকাশের নীচে হাঁটাচলা করলে যথেষ্ট অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ করে। এসব বিষয় শরীর এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। সেগুলো ঠিকমতো কাজ করে এবং শরীর থেকে নানা পদার্থ দূর করে।
ড. ক্রিস্টফ লেম্বেনৎসের মতো পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকও সেটা মনে করেন। তার মতে, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যাতে নির্ভরযোগ্যভাবে কাজ করে, সেটা নিশ্চিত করতে মানুষও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। কয়েকজন রোগীকে তিনি নিরাময়ের জন্য বাড়তি কিছু পদক্ষেপেরও পরামর্শ দেন।
ড. লেম্বেনৎস বলেন, 'লিভার ও কিডনিই সক্রিয়ভাবে শরীরকে বিষমুক্ত করে। সেগুলোকে আমি চাঙ্গা করে তুলতে পারি। যে পথ্য বেশ ঘনঘন ও সব জায়গায় কাজে লাগানো হয়, সেটা হলো লেবুর রস, গোলমরিচ ও আরও কিছু উপাদানের মিশ্রণ। আমরা যখন ল্যাবের রিপোর্ট দেখে রক্তে ফ্রি ফ্যাট, তথাকথিত ট্রাইগ্রিসারাইড পরিমাপ করি, তখন দেখি যে বিষাক্ত পদার্থ প্রায় অর্ধেক মাত্রায় কমে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা দুর্বোধ্য ডিটক্স পণ্য থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। তাদের মতে, দামী হলেও সেগুলো কোনো কাজে লাগে না। ওয়ান্ডার পিল্স, ক্লিনসিং জুস, স্পেশাল টি এর মতো পণ্যের বাজার বিশাল হলেও সেই ক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সেগুলোর মধ্যে আসলে কী আছে, কেউ তা জানে না।
পুষ্টিবিদ হিসেবে সুসানে উমবাখ জানান, ওষুধ, বড়ি বা গুঁড়ার মতো দেখতে হলেও সেগুলো আসলে খাদ্য। অর্থাৎ সেগুলোর কার্যকারিতা ও ক্ষতি করার ক্ষমতা পরীক্ষা করা হয় নি। বাজারে আনার আগে কর্তৃপক্ষ বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র দেয় নি।
পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসক ড. ক্রিস্টফ লেম্বেনৎস সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেন, এর কোনো বাড়তি প্রভাব নেই। শুধু কিছু মানুষের বিশাল আয় হয়। বাকিদের পকেট খালি হয়। তাদের মনে হয়, তারা ভালো কিছু করছেন।
ডিটক্সের নামে 'ফাস্টিং কিওর' প্রক্রিয়াও চালু আছে। কিন্তু উপবাসের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় জুড়ে খাদ্যগ্রহণ বন্ধ রাখতে হয়, যেমন 'ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং'। তবে ডিটক্স চিকিৎসার তুলনায় উপবাসের ফলে সত্যি কিছু উপকারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ড. লেম্বেনৎস বলেন, 'ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং আমাদের শরীরের সব অঙ্গের জন্য অত্যন্ত ভালো। ডায়াবেটিস না থাকলেও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমানোর ফলে সত্যি উপকার হয়। বড়দিনের ভোজের মতো সময়ের পর এমন প্রক্রিয়া সত্যি কার্যকর হয়।'
চিকিৎসা বিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গিতে ডিটক্স প্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় থাকলেও সেটিকে ঘিরে উৎসাহের অন্ত নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিটক্স পণ্যগুলো টাকা কামানোর মাধ্যম। ওয়ান্ডার পিল্সের উপর নির্ভর না করে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা বজায় রাখা অনেক বেশি জরুরি। সে ক্ষেত্রে যকৃতের মতো অঙ্গকে বাড়তি চাপ সামলাতে হবে না।