বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, এটা যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য তরুণ প্রজন্মের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা—এই তিনটি ক্ষেত্রে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে আপসহীন দায়বদ্ধতায় আবদ্ধ করতে তাদের মন ও মননে গুরুত্বারোপ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা, বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালি জাতি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। আর সেই প্রেক্ষাপটে তরুণ প্রজন্মের মন ও মননে দেশপ্রেমের চেতনা জাগ্রত করতে যে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহগুলো প্রেরণা হিসাবে কাজ করবে, তার মধ্যে রয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল, ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং স্বাধীনতাসংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার ৫১ বছরে দাঁড়িয়ে উল্লিখিত প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে অসাধারণ প্রেরণা জোগাবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে স্বাধিকার থেকে আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি জাতিরাষ্ট্র তথা সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে সমগ্র বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ গণ-অভ্যুত্থান দেশপ্রেমের চেতনার শানিত ফসল। বলা বাহুল্য যে, এই জাগ্রত চেতনা এবং প্রেরণার প্রতিফলন ঘটে ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফলে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ফলাফলের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অধিষ্ঠিত হন অবিসংবাদিত এক নেতৃত্বে। আর এই স্বীকৃতিই বঙ্গবন্ধুকে করে তোলে আত্মমর্যাদাশীল বাঙালি জাতি প্রতিষ্ঠা তথা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় একক নেতৃত্ব ও প্রেরণার উৎস হিসাবে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার আপামর জনগণই তাদের মন-মননে বঙ্গবন্ধুকে একক নেতৃত্ব ও দেশপ্রেমের প্রেরণার উৎস অধিষ্ঠিত করেন। সুতরাং আপামর জনগণের মন-মননে অধিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও নির্দেশনা হয়ে ওঠে অত্যন্ত তাত্পর্যবহ। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা অপরিহার্য। কেননা ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্বাপর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন আপামর বাঙালির আত্মত্যাগ তথা নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমের চেতনা—যা অনুকরণীয় এবং অনুসরণীয়। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির যে আত্মত্যাগ, শোষণ, নির্যাতন, জেল-জুলম হুলিয়ায় আবর্তিত তার একটি অন্যতম উদাহরণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জেল জীবন। প্রায় ১৩ বছরের অধিককাল জেলে বন্দি বঙ্গবন্ধু সব নির্যাতন সহ্য করেছেন বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায়। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লাখ লাখ নেতাকর্মী নির্যাতন, জুলুম সহ্য করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ। তাদের ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে দেশপ্রেমের এই চেতনা। এই চেতনাকে ভিত্তি করে দলমতনির্বিশেষে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল আপামর জনগণ। ব্যতিক্রম ছিল শুধু স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তানপন্থী কতিপয় রাজনৈতিক দল ও কিছু মানুষ, যারা আলবদর, রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল মূলত স্বাধীনতা ঘোষণার ভাষণ। যেটাকে আমার বিশ্লেষণে ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঘোষণা’ আর ২৬শে মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা হলো ‘প্রশাসনিক স্বাধীনতা ঘোষণা’। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির ৫১ বছরের যে শক্তি, তা হলো আপামর বাঙালির দেশপ্রেমের শক্তি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে প্রেরণা তা হলো দেশপ্রেমের প্রেরণা, বাংলাদেশ পাওয়ার যে সংগ্রাম—তা হলো আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়ার চেতনা, সর্বোপরি সঠিক সময়ে যথাযথ নির্দেশনায় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা। তরুণ প্রজন্মের মন ও মননে যে বিষয়গুলোর আধিক্য এবং আকর্ষণীয় সেসব বিষয় বঙ্গবন্ধুর আজীবন কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত।
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের সঠিক তথ্যপ্রবাহ সঞ্চালনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। এ কথা সবাই স্বীকার করছেন তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জীবিত করতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঠিক ইতিহাস ও তথ্যপ্রবাহ জানা এবং অনুধাবন অতীব প্রয়োজনীয়। সে লক্ষ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচনা, সেমিনার, প্রকাশনা কিছু দেখা গেলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং তথ্যসমৃদ্ধ বিষয়বস্তু যথাযথভাবে উপস্থাপন করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট ও সুপরিকল্পিত পাঠ্যসূচি। দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে লক্ষ্যদল হিসেবে নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পাঠদান, আলোচনা, সেমিনার, উৎসব আয়োজনের উদ্যোগকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেছে, একদিকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অন্যদিকে সামগ্রিক উন্নয়ন। এসব বিষয়কে মাথায় রেখে আগামী দিনের বাংলাদেশ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক নাগরিকের। আর এই নাগরিক গড়তে হলে শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্ব দিতে হবে। যে শিক্ষাব্যবস্থায় থাকবে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির যথাযথ উপস্থাপন। এক্ষেত্রে স্বাধীনতাসংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সংগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ, এবং স্বাধীনতা অর্জনবিষয়ক ইতিহাস সংযুক্তি গুরুত্ববহ।
তরুণ প্রজন্ম সব সময় তার মননে ও চেতনায় সাহসী, আধুনিক, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। আর এর সঙ্গে অবধারিতভাবে যুক্ত করে সততা, মানবিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং অ্যাচিভমেন্ট তেমনি রয়েছে আবেগ ভালোবাসার প্রাধান্য। সুতরাং তরুণ প্রজন্ম নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চায় আবেগ ভালোবাসায় জড়িয়ে সাহসী, দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে, যা বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক ও মানবিক গুণাবলির মধ্যে পরিলক্ষিত। বিজয়ের ৫১ বছরে এসে তরুণ প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস মন-মনন ও চেতনায় ধারণ করবে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করবে। বিজয়ের ৫১ বছরে এ প্রত্যাশা রইল তরুণ প্রজন্মের প্রতি।
লেখক: উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়