মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ৭ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে আমাদের সম্পৃক্ততা

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:৪৩

মাদারীপুর জেলার সর্বোদক্ষিণ প্রান্তে কালকিনি থানার অন্তর্গত গোপালপুর গ্রাম অবস্থিত। বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়কটি ভূরঘাটা বাজার থেকে উত্তরে মাদারীপুর ও ফরিদপুরের দিকে প্রসারিত। আমাদের কালকিনি-ভূরঘাটা সীমান্তের দক্ষিণেই অবস্থিত বরিশালের গৌরনদীর ভূরঘাটা বাজার, একটি সেতু দুই জেলার সংযোগের প্রতীক বা সীমানা হিসেবে বিদ্যমান।

১৯৭১ সনের ৭ই মার্চের বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত জাতিয় সংগ্রামী নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘোষিত ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।...তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’—এই উদাত্ত আহ্বানে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হয়ে, বিদ্যুত্ বেগে সাড়া দিয়ে পার্শ্ববর্তী বরিশালের গৌরনদী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমি ও আমার অগ্রজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী সবুর (ফরহাদ), মরহুম কাজী সাইদুর রহমান (শহীদ) বীর মুক্তিযোদ্ধা, সৈয়দ ফারুক রহমান বীর মুক্তিযোদ্ধা, মরহুম কাজী জাহিদুর রহমান মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ আরো কতিপয় গোপালপুরের তেজস্বী কৃতী সন্তানরা মাদারীপুর মহকুমার জনপ্রিয় সর্বশ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ নেতা, মৌলভী আছমত আলী খান সাহেবের নের্তৃত্ব ও নির্দেশনায় এবং কালকিনির কৃতী সন্তান, সংগ্রামী জননেতা মরহুম আব্দুল আজিজ সরদারের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে জনসভার কার্যক্রম শুরু করেছিলাম।

২৫শে মার্চ ১৯৭১-এর বিকালে আমি আমার একমাত্র বোনের ও আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় দুলাভাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ও ঘনিষ্ঠ সহচর, মহান মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত এমএনএ ও ৭৩-এ নির্বাচিত এমপি মরহুম আবিদুর রেজা খান (অ্যাডভোকেট) সাহেবের একমাত্র কন্যা, আমাদের ভাগনিকে নিয়ে টরকী বন্দর থেকে লঞ্চযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করেছিলাম, উদ্দেশ্য স্কুলে পড়ুয়া ভাগনিকে নানাবাড়ি গোপালপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া। লঞ্চের কেবিনে সেদিন আমাদের সহযাত্রী ছিলেন সাহেবরামপুর নিবাসী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বর্তমান আমেরিকায় বসবাসরত ড. মিজানুর রহমান সাহেবসহ কালকিনি গৌরনদীর বেশ কয়েক জন সম্মানিত ব্যক্তি। পরদিন, অর্থাত্ ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ মধ্যরাত্রের পর প্রায় সকাল চার/পাঁচ ঘটিকায় হঠাত্ অনুভব করলাম যে, লঞ্চটি চলছে না এবং ফতুল্লা ঘাটে স্থির হয়ে আছে। কেবিন থেকে বের হয়ে সারেং সাহেবকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারলাম যে, ইয়াহিয়া-ভুট্টোর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা গত রাত ১২ ঘটিকার পর ঢাকা শহরে ভয়াবহ আক্রমণ করে কয়েক হাজার মানুষ হত্যা করেছে। ২৬শে মার্চ ঊষালগ্নে ফতুল্লা লঞ্চঘাটের ওপরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মহাসড়কে মুহুর্মুহু জয়বাংলা স্লোগানসহ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও জনগণ বড় বড় গাছ ও বিভিন্ন সামগ্রীসহ প্রতিরোধ সৃষ্টি করছেন। আমাদের লঞ্চটি তখন ফতুল্লাহ লঞ্চঘাট ত্যাগ করে প্রথমে মুন্সীগঞ্জের মীর কাদিম বাজারে দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনালে পৌঁছলাম। মীর কাদিম ঘাটে পৌঁছানোর পূর্বে দেখতে পেলাম, নদীর কূল দিয়ে ঢাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ নারী-পুরুষ সমন্বয়ে বিশাল বিশাল কাফেলা ঢাকা থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য রাজধানী ঢাকা ছেড়ে পদব্রজে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে নদীর পাড়ের পথ দিয়ে মুন্সীগঞ্জের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তখনই সবাই আন্দাজ করে নিলাম যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গতরাতে রাজধানী ঢাকায় হয়তো-বা এক বর্বরোচিত নারকীয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা না হলে হাজার হাজার নর-নারী-শিশু কেন যার যার আবাসস্থল থেকে অসহ্য দুঃখ, কষ্টে এভাবে ঢাকা ছেড়ে জীবন বাঁচানোর জন্য কঠিন পথে হাঁটছেন? আমাদের লঞ্চের চালক, চাঁদপুর পৌঁছানোর পর পুনরায় আমাদের সব যাত্রীকে নিয়ে টরকী বন্দরের লঞ্চঘাটে ফিরে যেতে রাজি হলেন না। কারণ তার ও লঞ্চের অপর কর্মচারী স্টাফদের পরিবার-পরিজন সবাই ঢাকায় অবস্থান করছেন। লঞ্চটির ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা মাদারীপুরগামী ভূঁইঞা কোম্পানির একটি লঞ্চে আমাদের মাদারীপুর পর্যন্ত সবার যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আমাদের লঞ্চে তখন ঢাকার পিলখানা ইপিআরের কয়েক জন সদস্যসহ আমরা ২৭শে মার্চ সকালে মাদারীপুর পৌঁছলাম। আমার সঙ্গে সফরসঙ্গী আমার অবুঝ ভাগনিকে কোনো কিছু আঁচ করতে দেইনি।

২৭শে মার্চ আমি ঐ রিকশাযোগে আমার ভাগনিকে নিয়ে গোপালপুর-ভূরঘাটা মহাসড়কে আমাদের বাড়ির সম্মুখে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর ১টা থেকে দেড়টা ছিল। পৌঁছে দেখলাম, আমাদের গোপালপুর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়কের ওপর সহশ্রাধিক বিদ্রোহী জনতার লাঠি মিছিল ও সমাবেশ। আমি ঢাকা থেকে ফেরত এসেছি শুনে আমাকে ঐ বিশাল জনতা ঘিরে দাঁড়াল, ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার জন্য। তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছোট ভাষণ আকারে আমার দেখা ঢাকা থেকে প্রাণভয়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু-জনতার ঢাকা ছেড়ে পদব্রজে বুড়িগঙ্গা নদীর পশ্চিম তীর দিয়ে মুন্সীগঞ্জ মীরকাদিমের দিকে অগ্রসরমাণ জনতার কাফেলার কথা। সেদিনই আমি যোগদান করলাম গোপালপুর-কালকিনির ছাত্র-জনতার স্বাধীনতার আন্দোলনে।

মাদারীপুর শহরে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করেছিল ১৯৭১ এর ২৪শে এপ্রিল এবং বরিশাল শহরেও মোতায়েন করা হয়েছিল এপ্রিল মাসেই। মাদারীপুর ও বরিশাল হানাদার বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমরা গোপালপুরের ছাত্র-যুবক স্থানীয় জনতাকে সংগঠিত করে প্রতিদিন প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। অপরদিকে, দুপুর ও বিকাল থেকে শুরু করে ঢাকাসহ উত্তর বঙ্গের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত ছাত্র/ছাত্রী শিক্ষক, কর্মচারী, কর্মকর্তা ও পশ্চিমবঙ্গের যশোহর, কুষ্টিয়া, খুলনা হতে বরিশাল, পটুয়াখালী ভোলার দিকে অগ্রসরমাণ জনগণ নারী, শিশুদের ও অসুস্থ অতিভূগ্রস্ত জনগণকে কালকিনির ভূরঘাটা বাজারে স্থাপিত বিশেষ অভ্যর্থনাকেন্দ্রে খাবার ও পানির ব্যবস্থাকরণ এবং ওপারের গৌরনদী-ভূরঘাটা বাজার হইতে দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রীদের ঘরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার পরিবহন ব্যবস্থাকরণসহ ভূরঘাটা বাজারের দুই জেলার সংযোগস্থলে প্রতিরোধ সৃষ্টি করার এক কঠিন ও মহত্ কাজে নিজকেও সেদিন সমর্পিত করেছিলাম আমার সাথীদের সঙ্গে এক দুর্ভেদ্য শক্তিশালী সংগ্রামী বাহিনী হিসেবে।

 ২৫শে এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে সকাল প্রায় ১১ ঘটিকায় আমি এবং আমার চাচাতো ভাই তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স অধ্যয়নরত ও পরবর্তীতে ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক প্রধান মরহুম অধ্যাপক কাজী হান্নান ভাইসহ ভূরঘাটা বাজার হতে একটু দূরত্বে উত্তর-পশ্চিম দিকে আমাদের বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন প্রায় অর্ধেক পথে যাওয়ার পরই উত্তর দিকে দেখলাম যে, মাদারীপুর থেকে বরিশালের দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জলপাই রঙের গাড়ির এক বিশাল বহর এগিয়ে আসছে। আমরা দুই জন তখন অতিদ্রুত মহাসড়ক থেকে দৌড়ে পার্শ্ববর্তী আমাদের এক বিশাল জমির কোনায় গাছপালা, লতাগুল্মে বেষ্টিত বাহির থেকে অদৃশ্য প্রাকৃতিক এক আচ্ছাদনে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকলাম। মরহুম হান্নান ভাই ছিলেন একটু ভদ্র, নম্র, নিরীহ, শান্ত প্রকৃতির। হানাদারদের ধাবমান কনভয় দেখে তিনি একটু বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয়টি ভূরঘাটা বাজারের সম্মুখে এসে হঠাত্ থমকে দাঁড়ালে কনভয়ের শেষ প্রান্ত একটি সামরিক অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ায় ঠিক আমাদের দুজনের লুকায়িত অবস্থান থেকে প্রায় ৪/৫ শত মিটার দূরত্বে এবং পশ্চিমে নিকটবর্তী অর্থাত্ মহাসড়কের পশ্চিমে অবস্থিত আমাদের বাড়ির সম্মুখে। হানাদার বাহিনীর নিকট হয়তো বা ভূরঘাটা-বরিশালমুখী সড়কের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার সংবাদ জানা ছিল, যে কারণে বরিশাল অভিমুখী ঐ বিশাল কনভয়টি ২০/২৫ মিনিটের জন্য স্থিতিশীল হয়ে দণ্ডায়মান ছিল, মনে হয়েছিল যে, হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং যান্ত্রিক কোরের সৈনিকেরা যন্ত্রপাতি, স্ক্যানার দিয়ে ব্রিজের গোড়ায় মাটির নিচে পরীক্ষানিরীক্ষা করে কোনো মাইন অথবা বিস্ফোরকের অস্তিত্ব আছে বা নাই, যথাযথ নিশ্চিত হওয়ার পরই আবার কনভয়টি বরিশালের অভিমুখে যাত্রা করল। ইতিমধ্যে আমি ও মরহুম হান্নান ভাই ঝোপের আড়াল থেকে ঘর্মাক্ত অবস্থায় বের হয়ে হানাদারদের গাড়ির কনভয়ের অবস্থান দেখছিলাম। বরিশাল যাওয়ার পথে সর্বপ্রথম বার্থীর মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে কর্তব্যরত পুরোহিত বা ঠাকুরকে হত্যা করে ও মহাসড়কে বিক্ষিপ্তভাবে পায়চারিকৃত ভূরঘাটা বাজারের সকলের প্রিয় মাস্তানজিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। ২৭/২৮ এপ্রিল, ১৯৭১ পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর দুটি সম্ভবত হাল্কা আক্রমণকারী বিমান অতর্কিত গৌরনদীর ওপারের ভূরঘাটা হতে শিকারপুর-উজিরপুর মহাসড়কের ওপর সমবেত জনতা ও হাজার হাজার পথচারী বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর বিমান থেকে সমগ্র মহাসড়কের ওপর Aerial Shelling বা গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমিসহ তখন অনেকেই ওপারের ভূরঘাটা বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন হোটেলস্থ স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের প্রধান যোগাযোগ কেন্দ্রের পিছনে এক বিশাল ডোবা নালা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলাম। বিমান হামলা বন্ধ হওয়ার প্রায় আধাঘণ্টা পর আমি অবলোকন করলাম যে, আমার পায়ের স্যান্ডেলের পাটির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে রক্তে আঠাযুক্ত হয়ে আছে। তখন বুঝলাম যে, ঐ বিশাল ডোবায় স্তূপকৃত আবর্জনার মধ্যে ভাঙা কাঁচের বোতল অথবা কোনো একটি ধারাল তীক্ষ বস্তুর আঘাতে আঙুলের রক্তক্ষরণ হয়েছে।

আমার বাবা বৃটিশ সময়ে দারজিলিংয়ের অক্সফোর্ড বিদ্যালয়ে তখনকার এনট্রান্স পরীক্ষা শেষে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চাকরি করেছেন এবং তার চাচা সার্জন অফ ইন্ডিয়া মরহুম কাজী আব্দুস সাত্তারের তত্ত্বাবধানে পড়াশুনা করেছিলেন। বাবা উর্দু, হিন্দি এবং ইংরেজিতে পরদর্শী ছিলেন এবং অনর্গলভাবে কথা বলতে পারতেন ও বুঝতেন বিধায় আমাদেরকে বলেছিলেন যে, তোমরা নিরপদ স্থানে আত্মগোপনে চলে যাও। কালকিনি ও পার্শ্ববর্তী গৌরনদীতে চলমান প্রতিদিনকার এই নারকীয় হত্যা, ধর্ষণ, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ ও পাকিস্তানি ঘাতক হানাদার বাহিনীর উপযুক্ত ও শক্তিশালী জবাব প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় যথাযথ সামরিক ও গেরিলা প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে নিজেদেরকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে আমিসহ সর্বজনাব কাজী হুমায়ুন কবির ও অগ্রজ ভ্রাতা কাজী সবুর ফরহাদ, মরহুম কাজী সাইদুর রহমান, আব্দুর রহিম মাস্টার, সৈয়দ মোশারফ হোসেনসহ গোপালপুর ও বীরমোহন মাইজপাড়ার কয়েক জনসহ প্রায় ২০ জনের একটি দল ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় চলে গিয়েছিলাম। আমাদের দেশত্যাগ করে ভারতের ত্রিপুরায় যাওয়ার বিষয়ে উত্সাহ ও সহযোগিতা করেছিলেন আমাদের চাচাতো ভাই, রাজনীতির দিক দিয়ে বেশ সচেতন, স্বাধীনতা ও গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে উদ্বুদ্ধ ও কঠোর মনোভাবের অধিকারী মরহুম কাজী বোরহান ভাই। ভারতের ত্রিপুরাস্থ আগড়তলা যাত্রাটি ছিল আমাদের জন্য যেমন দুরুহ, ঝুঁকিপুর্ণ তেমনি এক অনিশ্চিত যাত্রা।

আমাদের টিমের কয়েক জন ছিলেন গ্রামের সহজ-সরল, সাদাসিদে মানুষ। বিদেশের এই মহাসংকটকালে নিজেদের ভবিষ্যত্ অবস্থান কী হবে ভেবে খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। তখন আমি ও অগ্রজ ফরহাদ ভাই দ্রুত মানবিক দিক বিবেচনা করে সহযাত্রী টিমের সদস্যদের ত্যাগ করে দেরাদুনে প্রশিক্ষণে যাওয়ার মনবাসনা ত্যাগ করলাম। সবাই এই কথা শোনার পর সহসাই তাদের চোখেমুখে আবার আনন্দের অশ্রুবন্যা বয়ে যায়। বিজনা ইউথ ক্যাম্পে দুই/তিন দিন থাকার পর আমাদের নেওয়া হয়েছিল আগড়তলা শহর থেকে প্রায় ৩০/৩৫মাইল দূরত্বে ‘গঙ্গা ইউথ ক্যাম্পে’ ক্যাম্পটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বাঙালি ক্যাপ্টেন চাতার্জী। গঙ্গা-যমুনা পাশাপাশি দুইটি ক্যাম্প। ত্রিপুরা বাংলাদেশের পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত আমাদের গেরিলা প্রশিক্ষণের প্রত্যাশী অসংখ্য তরুণ যুবক মাতৃভূমি বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করার এক দৃঢ় লৌহ ইস্পাতের ন্যায় শক্ত মনবল ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গেরিলা, সামরিক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য ইয়ুথ ক্যাম্প দুটো-সহ আগড়তলার বিভিন্ন ক্যাম্পে সমবেত হয়েছিলেন।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক।

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন