শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৮ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

‘ভয় আছে সব জানা’

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ১৬:১৬

দশ যুগকাল আগে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’। এ যেন লাল-সবুজের বাংলার বিজয়গাঁথাকে উদ্দেশ্য করেই লেখা! এ যেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উদ্দেশ্য করেই রচিত!

এ যেন মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি, যার রাজনীতিবিদ হিসেবে বেড়ে ওঠার শুরু স্কুলজীবন থেকেই। শৈশবেই যিনি অবতীর্ণ হন নেতৃত্বের ভূমিকায়! দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তানি নির্যাতন, জেল-জুলুম সহ্য করে বারবার ফাঁসির মুখোমুখি হয়েও স্বীয় আদর্শ ও লক্ষ্য থেকে একটুও পিছপা হননি বঙ্গবন্ধু। সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা—বঙ্গবন্ধু। হয়ে ওঠেন শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির মুক্তির প্রতীক, বাঙালি জাতির পিতা। প্রতিষ্ঠা করেন বাঙালি জাতি ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ যে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ে, তা বঙ্গবন্ধুরই দান।

বঙ্গবন্ধুর গোটা জীবনটাই যেন মানবিকতায় পূর্ণ। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়াকালীন গৃহশিক্ষক কাজী আবদুল হামিদ এমএসসি পরিচালিত ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন শেখ মুজিব। ছাত্রদের বই, পরীক্ষার ফি, জায়গিরের ব্যবস্থাসহ অন্যান্য খরচের জোগান দিত এই সমিতি। হঠাৎ মাস্টার সাহেব যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর সেবা সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে মানবিক শেখ মুজিব।

বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ মানেই ‘৭ই মার্চ’। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখ লাখ মুক্তিকামী বীর বাঙালির সামনে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত হয়, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ চারদিক প্রকম্পিত করে এ বজ্রধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ৭ই মার্চের হাত ধরেই স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এরপর আসে সেই কালো রাত—২৫শে মার্চ। নিরস্ত্র বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যায় মেতে ওঠে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। কালরাত্রির নিকষ আঁধার কাটতে শুরু করে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু। ভয় পেয়ে যায় হায়েনারা। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে বাংলার বন্ধুকে। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আপামর দুর্মর বাঙালি। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। শুরু হয় ‘মুক্তির যুদ্ধ’। শুরু হয় অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। শুরু হয় অধিকার হরণকারী হন্তারকদের বিরুদ্ধে বাঙালির সর্বাত্মক প্রতিরোধ। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ৪-৩১ মিনিটে ৭ই মার্চের সেই রেসকোর্স ময়দানেই রচিত হয় বাঙালির বীরত্বগাথা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ৯১ হাজার ৫৪৯ জন সেনার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাংলার স্বাধীনতা—স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ স্বাধীন হয় বটে; কিন্তু হায়েনাদের নীলনকশা থামে না। গোপনে কারাগারের অভ্যন্তরে প্রহসনমূলক বিচারের নামে গ্রেফতারকৃত বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানি জান্তা সরকার! ইতিমধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় এবং বিশ্ববাসীর চাপে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান।

এই যে সাহস, ত্যাগ ও সর্বসাধারণের প্রতি ভালোবাসা— এগুলোই বঙ্গবন্ধুকে এনে দেয় বিরল সম্মান। বিশ্ববরেণ্য নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন জনদরদি বঙ্গবন্ধু। হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতিসত্তার মূর্ত প্রতীক। সুদীর্ঘ অহিংস স্বাধীনতাসংগ্রামের কৃতিত্বস্বরূপ বঙ্গবন্ধুকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করে দেশ-বিদেশের বহু সমাজ, গোষ্ঠী, ব্যক্তি-নেতা। বঙ্গবন্ধুকে তুলনা করা হয় সুউচ্চ হিমালয় পর্বতের সঙ্গে। মুকুটহীন সম্রাট, রাজনীতির কবি, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, আপসহীন নেতা, বিশ্ববন্ধু—কোন বিশেষণের ব্যবহার হয়নি বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ-অবদানের স্বীকৃতিতে! তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন। বাঙালির প্রতিদিনের পথচলার অনুপ্রেরণা তিনি।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল মানুষের জন্য। সাধারণ মানুষের জন্য। দুঃখী এবং শোষিত-বঞ্চিত জনগণের জন্য। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের অর্ধেকেরই বেশি সময় তিনি কারাবন্দি ছিলেন। রাজনীতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন অন্ধকার কারাগারে কাটানো নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কজন আছে! বঙ্গবন্ধুর সব থেকে বড় কৃতিত্ব—হাজারো বাধাবিপত্তির মুখেও তিনি পিছু হটেননি। ভেঙে পড়েননি। সৎ আদর্শকে বুকে ধারণ করে, নীতি-বিশ্বাসে অটুট থেকে এগিয়ে গেছেন সম্মুখপানে। সব পরিস্থিতিতে ত্যাগ স্বীকারে তিনি ছিলেন আগুয়ান। যখনই তিনি সুযোগ পেতেন, ছুটে যেতেন জনগণের কাছে। কারাগার থেকে বের হয়ে দৌড়ে যেতেন বাঙালির কাছে। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশের মাটিতে পা দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার-পরিজনের কাছে ছুটে যাননি; ছুটে গেছেন জনতার কাছে, বাঙালি মিছিলে! বলতেই হয়, বাংলাদেশ ও বাঙালির ‘কপাল’—পেয়েছিল একজন বঙ্গবন্ধুকে, একজন খাঁটি দেশপ্রেমিককে। লাল-সবুজের বাংলাদেশ পেয়েছিল ‘একজন শেখ মুজিবুর রহমান’কে। বাংলার জনগণও বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছে উজাড় করে—মহান নেতার আদর্শে বলীয়ান হয়ে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। আজ বাংলার সর্বস্তরের জনগণের হৃদয়ে ‘মহা আসন’ দখল করে আছেন বঙ্গবন্ধু। শুধু বাঙালি ও বাংলাদেশেই নয়, বহুমাত্রিকভাবে তিনি আছেন বিশ্বের বহু কোটি মানুষের অন্তরে। গ্রাম-মহল্লায় বেড়ে ওঠা এক খোকার বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে জায়গা করে নেওয়ার মহাকাব্য বাঙালির জন্য পরমানন্দের, গর্বের-গৌরবের।

পরিশীলিত, পরিমার্জিত, পরিশুদ্ধ, পরোপকারী, পরশ্রীকাতরতাবিমুখ, পরিমিতিবোধসম্পন্ন মানুষই ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে  সোনার মানুষ। এসব গুণসম্পন্ন মানুষকে বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সূত্রও দিয়ে গেছেন। জীবনে তিনি বহুবার বলেছেন,‘সোনার বাংলা গড়ার জন্য আমার সোনার মানুষ চাই।’ যে প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’, সে দেশের প্রত্যেক নাগরিক হবে সোনার মানুষ—এই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের প্রত্যয় ও প্রত্যাশা।

বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনুভব করি দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের এক সুনিবিড় স্পন্দন, সব বন্ধন থেকে মুক্তির প্রাণোচ্ছ্বাস। বাঙালির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মধ্যে অনুপ্রেরণা, আস্থা, বিশ্বাস ও আশ্রয়ের প্রতীক হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনই আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। বিজয়ের ৫১ বছর পেরিয়ে আগামী দিনের বাংলা ও বীর বাঙালি যেকোনো বিপত্সংকুল পরিস্থিতিতে গীতাঞ্জলির চরণগুলোর মতোই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বক্ষে ধারণ করে এগিয়ে যাবে সম্মুখপানে—‘কে ডাকে রে পিছন হতে,/ কে করে রে মানা,/ ভয়ের কথা কে বলে আজ—/ ভয় আছে সব জানা’।

লেখক: পুলিশ সুপার, চুয়াডাঙ্গা

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন