রোববার, ২৬ মার্চ ২০২৩, ১২ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

৫ টাকার নোটে মুদ্রিত

পরিচিতি পাচ্ছে না ৪৬০ বছর পুরনো সুলতানি আমলের কুসুম্বা মসজিদ

আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২২, ১৫:২৩

সুলতানি আমলের পুরাকীর্তি নওগাঁর ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ। যা বর্তমানে পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত। মসজিদটি জেলার ইতিহাস ও মুসলিম ঐতিহ্যে বহন করে। তবে প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে আকর্ষণীয় স্পট হিসেবে গড়ে উঠছে না বলে অভিযোগ করেছেন দর্শনার্থীরা।

মান্দা উপজেলায় নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের মান্দা সেতুর পশ্চিম দিকে প্রায় ১ কিলোমিটার উত্তরে কুসুম্বা মসজিদটি অবস্থিত। প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন এই মসজিদটি দেখার জন্য।

জানা গেছে, মসজিদটি বাংলা চালা ঘরের মতো উত্তর-দক্ষিণে ঈষৎ বক্র। মসজিদ সংলগ্ন উত্তর-দক্ষিণ দিকে ৭৭ বিঘা বিশিষ্ট একটি বিশাল দিঘি রয়েছে। দিঘিটি লম্বায় প্রায় ১২০০ ফুট ও চওড়ায় প্রায় ৯০০ ফুট। গ্রামবাসী এবং মুসল্লিদের খাবার পানি, গোসল ও অযুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য এই দিঘিটি খনন করা হয়েছিল। এই দিঘির পাড়েই নির্মাণ করা হয়েছে ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ।

কুসুম্বা মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা, ৪২ ফুট চওড়া। চারদিকের দেওয়াল ৬ ফুট পুরু। বাইরের অংশ পাথর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে তিনটি দরজা। আকারে দুটি বড়, অন্যটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দরজাগুলো খিলানযুক্ত মেহরাব আকৃতির। মসজিদের চার কোনায় রয়েছে চারটি মিনার। মিনারগুলো মসজিদের দেওয়াল পর্যন্ত উঁচু ও আট কোনাকার। ছাদের ওপর মোট ছয়টি গম্বুজ রয়েছে। যা দুই সারিতে তৈরি।

দ্বিতীয় সারির গম্বুজগুলো আকৃতির দিক দিয়ে ছোট। ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে তিনটি গম্বুজ নষ্ট হয়েছিল। পরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি সংস্কার করে। মসজিদের ভেতর দুটি পিলার রয়েছে। উত্তর দিকের মেহরাবের সামনে পাথরের পিলারের ওপর তৈরি করা হয়েছিল একটি দোতলা ঘর। এই ঘরটিকে বলা হতো জেনান গ্যালারি বা মহিলাদের নামাজের ঘর। এখানে মহিলারা পৃথকভাবে নামাজ পড়তেন। মসজিদের ভেতর পশ্চিমের দেয়ালে রয়েছে তিনটি চমৎকার মেহরাবের ওপর ঝুলন্ত শিকল এবং উন্নতমানের কারুকাজ করা। দক্ষিণ দিকের মেহরাব দুটি আকারে বড়। উত্তর দিকের মেহরাবটি ছোট। মসজিদটির উত্তর-দক্ষিণ দিকে দুটি করে দরজা রয়েছে।

ছবি: ইত্তেফাক

মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে খোলা প্রাঙ্গণ ও পাথর বসানো সিঁড়ি। যা দিঘিতে গিয়ে নেমেছে। মসজিদের প্রবেশ পথের ‌একটু দূরে বাক্স আকৃতির একখণ্ড কালো পাথর দেখা যায়। এটিকে অনেকে কবর বলে মনে করেন।

তথ্যমতে, জনৈক কৃষক হাল চাষের সময় তার জমিতে পাথরটির সন্ধান পায়। সম্ভবত তার প্রচেষ্টায় পাথরটি জমি থেকে তুলে এনে রাস্তার পাশে রাখা হয়েছিল। এই পাথরের গায়ে তোগড়া হরফে আরবিতে লেখা রয়েছে, ‘আল মালেকু মা হুমম মোকাররামা আবুল মোজাফফর হোসেন শাহ বিন সৈয়দ আশরাফ আল হোসেন।’ যার অর্থ ‘তিনি শাসক যিনি পরাক্রমশালী ও সন্মানের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আল হুসেনের পুত্র আবুল মোজাফর হোসেন শাহ। এ থেকে বোঝা যায় প্রস্তুর খণ্ডটি হুসেন শাহের স্মৃতি বিজড়িত।

যতদূর জানা যায়, সবরখান বা সোলায়মান নামে ধর্মান্তরিত এক মুসলমান মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের দুটি শিলালিপির প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তবে মূল প্রবেশ পথে শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় এই মসজিদটি ৯৬৬ হিজরি বা ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দের। শের শাহের বংশধর আফগান সুলতান প্রথম গিয়াস উদ্দীন বাহাদুরের শাসনামলে (১৫৫৪-১৫৬০ সালে)নির্মিত। সে হিসাবে মসজিদটির বর্তমান বয়স ৪৬০ বছর।

কুসুম্বা মসজিদে ব্যবহৃত পাথর অন্য কোনও প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে সংগৃহীত হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। এই শিলালিপি পাঠে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা রামন দল কর্তৃক ৯০৪ হিজরি বা ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ কবে হয় তার সঠিক সাল বা তারিখ জানা যায়নি।

দর্শনার্থী রবিন বলেন, পাঁচ টাকার নোটের ওপর ছবি দেখে অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এখানে বেড়াতে আসার।

অপর দর্শনার্থী আনোয়ার হোসেন বলেন, বিপুল সম্ভবনা থাকার পরও প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে নওগাঁর এই ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ আকর্ষণীয় স্পট হিসেবে গড়ে উঠছে না।

এ ব্যাপারে মান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু বাক্কার সিদ্দিক জানান, কুসম্বা মসজিদটি নওগাঁর ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রতিদিন দর্শনার্থী আসেন মসজিদটি দেখার জন্য। দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য অযু ও গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া দর্শনার্থীদের আরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

ইত্তেফাক/আরএজে