বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

বাংলাদেশের নারীরা দেশের ভবিষ্যতের জন্য অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসছেন: লিডা নুরি

আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২২, ০৪:৩৭

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গ্লোবাল উইমেনস ইস্যুজ (এস/জিডব্লিউআই)-এর সিনিয়র অ্যাডভাইজার লিডা নুরি সম্প্রতি দৈনিক ইত্তেফাককে একটি সাক্ষাত্কার দিয়েছেন। অনলাইনে সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ করেছেন রিপোর্টার মোর্শেদা ইয়াসমিন পিউ

ইত্তেফাক: নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের নারী সদস্যরা অবদান রেখে চলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিটা কেমন? যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীতে নারী-পুরুষের সংখ্যার অনুপাতে কি লৈঙ্গিক ভারসাম্য বজায় থাকে? বাংলাদেশের নারী পুলিশ অফিসারদের ক্ষমতায়নের জন্য কী ধরনের প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন?

লিডা নুরি: সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীতে নারীদের অন্তর্ভুক্তিতে সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই দারুণ প্রচেষ্টা দেখিয়েছে। শান্তিরক্ষী, কমান্ডার, পাইলট ও পুলিশ অফিসার হিসেবে তাদের অপরিহার্য ভূমিকা শুধু সব নাগরিকের জননিরাপত্তা উন্নয়নের ক্ষেত্রেই অবদান রাখছে না, বরং এমন অনেক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ তুলে ধরার ক্ষেত্রেও অবদান রাখছে, যেখানে নারীর সম্পৃক্ততা অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। যেসব পুলিশ প্রশিক্ষণ নারীর জন্য প্রয়োজনভিত্তিক নেতৃত্ব ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, ট্রমা সচেতন যত্ন এবং বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিদের একসঙ্গে শেখার সুযোগ করে দেয়, সেখানে সহায়তা নারীর ভূমিকা বৃদ্ধি এবং কার্যকরভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তুলতে বাংলাদেশের অঙ্গীকারকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রও নিরাপত্তা খাতের সব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণকে সমান জরুরি বলে মনে করে এবং নারী ও পুরুষের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দেয়। সেনাবাহিনীতে এবং স্থানীয়, প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় নারীরা নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে আছেন। চার তারকা জেনারেল থেকে সাধারণ সৈন্য, পুলিশপ্রধান থেকে পেট্রল অফিসার পর্যন্ত নারীরা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণ ও পরিচালনার সব পর্যায়েই অংশগ্রহণ করছেন এবং এগিয়ে নিচ্ছেন। এর আগে দুটি বিশ্বযুদ্ধেই নারীরা অংশগ্রহণ করলেও ১৯৪৮ সালে উইমেনস আর্মড সার্ভিসেস লেজিসলেশন অ্যাক্ট পাশের পর থেকে সামরিক বাহিনীতে নারীর অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সামরিক বাহিনীর ১৮ দশমিক ৬ শতাংশই এখন তাদের দখলে এবং ২০০৫ সালের পর কোনো ধরনের যুদ্ধ-মিশন থেকেই তাদের বাদ দেওয়া হয় না। সেনাবাহিনীর নারী সদস্যরা ধীরগতিতে কিন্তু ক্রমেই আরো বেশি হারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন সম্মুখ যুদ্ধসংক্রান্ত কাজে। যদিও স্পেশাল অপারেশন্স ফোর্সে নারীর অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে।

ইত্তেফাক: যুক্তরাষ্ট্রে নারীর প্রতি সহিংসতা মোকাবিলা করা হয় কীভাবে? ভিকটিমদের কী ধরনের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দেওয়া হয়?

লিডা নুরি: যখনই লৈঙ্গিক সহিংসতার ঘটনা ঘটবে, তখনই এর নিন্দা জানাতে হবে, তা সে যুক্তরাষ্ট্রে হোক বা অন্য কোনো দেশে। নারী ও মেয়েদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন হলো যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক ও জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত নীতিমালার একটি কেন্দ্রীয় অংশ। যুক্তরাষ্ট্র নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা ইস্যুতে সুরক্ষা এবং বৈশ্বিকভাবে লৈঙ্গিক সহিংসতা রুখে দেওয়া ও মোকাবিলার জন্য প্রেসিডেন্টের একাধিক নির্বাহী আদেশ জারি করেছে, যার মধ্যে আমাদের সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মোদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা দুটোই রয়েছে। বৈশ্বিকভাবে লৈঙ্গিক সহিংসতা প্রতিহত ও মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের যে কৌশলপত্র রয়েছে, তার একটি আপডেট শিগিগরই প্রকাশ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং আগামী বছর প্রথম বারের মতো লৈঙ্গিক সহিংসতা বন্ধের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করা হবে। ঘরোয়া সহিংসতা, ডেটিং সহিংসতা, যৌন সহিংসতা ও নজরদারির মতো লৈঙ্গিক সহিংসতার শিকার নারীদের সহায়তা ও সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট ওমেন রি-অথরাইজেশন অ্যাক্টের মতো আইন।

ইত্তেফাক: নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং কিছু বদ্ধমূল সামাজিক ধারণা। আমেরিকায়ও কি এ ধরনের বাধা আছে? কীভাবে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত শক্তিগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানো ও মোকাবিলা করা হয়?

লিডা নুরি: নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নানান ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাধা এবং বদ্ধমূল সামাজিক ধারণা গোটা বিশ্বেই রয়েছে। নারী ও মেয়েদের জন্য বৃহত্তর পরিসরে সমতাবিধান এবং এসব বদ্ধমূল ধারণা ও পক্ষপাত নির্মূলের লক্ষ্যে বিদ্যমান বাধা ও চ্যালেঞ্জ কমাতে কাজ করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব ইস্যুতে অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন বহুমুখী উদ্যোগ, যার মধ্যে আছে বিভিন্ন খাতের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃত্ব এবং সুশীল সমাজ ও মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সংলাপ। এর জন্য আরো প্রয়োজন বিভিন্ন সহায়ক নীতিমালা, কৌশল ও আইন তৈরি এবং এগুলোর বাস্তবায়ন। নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজ দেশে ও বহির্বিশ্বে লৈঙ্গিক সমতা বাড়ানোর জন্য হোয়াইট হাউজ জেন্ডার পলিসি কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেছে বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসন।

ইত্তেফাক: বাংলাদেশ নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী? বাংলাদেশি নারীদের নিয়ে আপনার ভাবনা কেমন? বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে আপনি কীভাবে এর সাফল্যের মূল্যায়ন করবেন?

লিডা নুরি: এই সফরের সময় বাংলাদেশের অনেক চমকপ্রদ নারী নেত্রীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছে। তারা সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে যেসব সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে তার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল এ দেশের নারীদের কঠোর পরিশ্রম ও শক্তিশালী নেতৃত্ব। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উত্পাদনশীলতার ক্ষেত্রে এবং বৃহত্তর পরিসরে অর্থনীতিকে লাভবান করে। মহামারির ঠিক আগ দিয়ে এ দেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ৩৬ শতাংশের বেশি, যেটি এই অঞ্চলের অন্যতম সেরা হার। গ্রামীণ অঞ্চলসহ গোটা বাংলাদেশে নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যেসব অগ্রগতি হয়েছে, সেগুলো ধরে রাখা এবং আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিতে নারীর বৃহত্তর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেসব উদ্ভাবনী প্রকল্প পরিচালনা করছে, তার ভালো কিছু উদাহরণ হলো লাখো নারীর জন্য ক্ষুদ্র অর্থায়নের সুযোগ এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রকল্প। যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসও সম্প্রতি একাডেমি ফর ওমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরসের যাত্রা শুরু করেছে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ পটভূমির নারীদের সমর্থন দেওয়া হবে, যেন তারা তাদের বিভিন্ন উদ্যোগের স্বপ্নগুলো টেকসই ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগে রূপ দিতে পারেন। এই প্রচেষ্টাগুলোর মাধ্যমে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হবে, যা এই বাজারে নারীদের সফল হতে সহায়তা করবে। সরকারি খাত থেকে বেসরকারি খাত পর্যন্ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা থেকে শুরু করে শান্তিরক্ষা কার্যক্রম পর্যন্ত, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বোর্ডরুম পর্যন্ত, বাংলাদেশের নারীরা তাদের দেশের ভবিষ্যতের জন্য অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসছেন। যদিও আরো কিছু করার সম্ভাবনাও সব সময়ই থাকে। আরো বেশি ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজন নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যগুলো আরো কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট নানা উদ্যোগ চালিয়ে যাওয়া, লৈঙ্গিক সহিংসতার বিষয়গুলো তুলে ধরা এবং নারী ও মেয়েদের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়। বাংলাদেশের নারীদের সন্দেহাতীতভাবে অনেক উল্লেখযোগ্য অর্জন আছে। এবং যদি আরো বেশি পরিমাণে নারী ও মেয়ে লৈঙ্গিক সহিংসতা ও অনলাইন হয়রানি থেকে মুক্ত থাকতে পারে এবং কম বয়সে বিয়ের জন্য বাধ্য না হয়ে স্কুলে যেতে পারে, তাহলে চিন্তা করুন বাংলাদেশ আরো কত উন্নতি করতে পারবে। কারণ এখানে আছে অফুরন্ত সম্ভাবনা।

ইত্তেফাক: এশিয়া বংশোদ্ভূত অনেক নারী এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে আছেন। এমনকি আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এই বিষয়কে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

লিডা নুরি: যুক্তরাষ্ট্রের একটি অন্যতম শক্তির জায়গা এর বৈচিত্র্য। এই নীতি আরো শক্তিশালী হয়েছে আমাদের কেন্দ্রীয় শ্রমশক্তিতে বৈচিত্র্য, সমতা, অন্তর্ভুক্তিকরণ ও প্রবেশাধিকার (ডিইআইএ) আরো বাড়ানো এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ পটভূমির রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়োগের জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ঐতিহাসিক নিয়োগটি শুধু প্রথম নারী হিসেবেই নয়, তিনি এই পদ পেয়েছেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয় ব্যক্তি হিসেবে। আমরা একটি বৈচিত্র্যময় বিশ্বে বাস করি, যেখানে নানা জটিল ইস্যু তুলে ধরা এবং বিস্তৃত পরিসরের চ্যালেঞ্জ ও সুযোগসংক্রান্ত সমাধানগুলো শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজন বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মশক্তি।

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন