আমাদের সামাজিক, রাষ্ট্রীয় আন্তর্জাতিক পরিসরে অনেক ক্ষেত্রেই এমন একটি পরিস্থিতি দাঁড়ায়—যখন আমরা বুঝিতে পারি, যাহা করিতে চাহিতেছি তাহা করা উচিত নহে; কিন্তু উহা না করিয়াও উপায় নাই। যেমন বলা হয়—মিথ্যা বলা পাপ; কিন্তু জীবন বাঁচাইবার জন্য মিথ্যা বলা পাপ নহে। একইভাবে বলা হয়—‘নেসেসিটি নোউজ নো ল’। অর্থাৎ প্রয়োজনীয়তা কোনো আইন জানে না। এই কথাটি এখন প্রবাদে পরিণত হইয়াছে—যাহা ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের তত্কালীন আইনি উপদেষ্টা স্যার জেরাল্ড ফিত্জমারিস প্রথম উচ্চারণ করিয়াছিলেন। কথাটি তিনি বলিয়াছিলেন মিশরকে আক্রমণের যৌক্তিকতা তুলিয়া ধরিবার ক্ষেত্রে—যাহা ছিল আন্তর্জাতিক আইনবিরুদ্ধ; কিন্তু ইংল্যান্ডের জন্য ছিল জরুরি। কারণ সেই সময় মিশরের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন গামাল আবদেল নাসের সুয়েজ খালকে জাতীয়করণের ঘোষণা করেন এবং তাহার ফলে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের ঘুম হারাম হইয়া যায়। কেননা এই দুই দেশের নিকটই তখন সুয়েজ খালের শেয়ার ছিল। মধ্যপ্রাচ্য হইতে তৈল ও অন্যান্য পণ্য এই নৌপথ দিয়াই ইউরোপে পৌঁছাইত এবং ইউরোপের কলকারখানা চলিত। সুয়েজ সংকটের যুদ্ধে ইংল্যান্ড যদিও বেশ বেকায়দায় পড়িয়াছিল তখনকার স্নায়ুযুদ্ধের পরিস্থিতি ও আমেরিকার হস্তক্ষেপের কারণে। ইতিহাসের সেই বিষয়টি বিশদে বলিবার দরকার নাই। যাহা বলিবার, তাহা হইল—‘প্রয়োজনীয়তা কোনো আইন জানে না।’ আমেরিকান জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল ল’-এর সম্পাদকীয়তে বিশ্বযুদ্ধের একটি পরিস্থিতি লইয়া বলিয়াছিল—‘অতএব ইহা প্রতীয়মান হয় যে, চ্যান্সেলর জানিতেন এবং স্বীকার করিয়াছিলেন যে, বেলজিয়াম এবং লুক্সেমবার্গের দখল আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি; কিন্তু তিনি এই বিবৃতি দিয়া এই কাজটিকে ন্যায্যতা দিয়াছেন যে, জার্মান সাম্রাজ্য ছিল বিশেষ পরিস্থিতির প্রয়োজনের মুখে এবং সেই ‘প্রয়োজনীয়তা’ কোনো আইন জানে না।’
প্রকৃতপক্ষে, এই প্রবাদের নিদর্শন প্রতিনিয়তই আমরা আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মপরিধিতে দেখিতে পাই। উদাহরণ হিসাবে জার্মানির সাম্প্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখ করা যাইতে পারে। জার্মানির নিজেরই বেশ কিছু পিট-কয়লা খনি রহিয়াছে; কিন্তু সবুজ পৃথিবীর অন্যতম সচেতন এই দেশটি ঠিক করিয়াছে—কয়লা হইতে ক্রমশ তাহারা দূরে থাকিবে। এই জন্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসারণ কমাইতে জার্মানি ধাপে ধাপে কয়লার ব্যবহার হ্রাসের কাজ শুরু করিয়াছে বেশ কয়েক বত্সর পূর্বেই। ফলে কয়লা আমদানি ক্রমান্বয়ে কমাইয়া আনিয়াছে দেশটি; কিন্তু মাত্র কয়েক দিন পূর্বেই জার্মানির কয়লাসমৃদ্ধ একটি গ্রামে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু করিয়াছে। অনেক বাসিন্দাকে স্থানান্তরিত করা হইয়াছে যাহাতে কয়লা উত্তোলনের জন্য মাটি খনন করা যায়। যদিও ইহার জন্য তাহারা গ্রামবাসীর প্রতিবাদের মুখে পড়িয়াছে; কিন্তু ডয়চেভেলের খবরে বলা হইয়াছে, জার্মানি যেইহেতু রাশিয়ার গ্যাস এবং তৈলের উপর নির্ভরতা কমাইয়াছে, সেইহেতু দেশটির জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করিয়াছে যে, কয়লাকে আরো কয়েক বত্সর ধরিয়া শক্তির উৎস হিসাবে ব্যবহার করিতেই হইবে। অর্থাৎ সেই পুরাতন প্রবাদ—‘প্রয়োজনীয়তা কোনো আইন জানে না।’ এই প্রবাদটি নিঃসন্দেহে যে কোনো আইনবহির্ভূত কাজের পক্ষে সাফাই গাইবার একটি চমত্কার ট্রাম্প কার্ড। যদিও এই ট্রাম্প কার্ড যখন-তখন এবং বারবার খেলা যায় না; কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে এখনো পৃথিবীর ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে ইহার প্রয়োগ দেখা যায়।
মানুষ সভ্য হইতেছে, নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন আইন তৈরি করে, আবার নিজেদের প্রয়োজনেই সেই আইন অমান্য করিয়া থাকে। তবে ‘প্রয়োজনীয়তা কোনো আইন জানে না’—কথাটির মধ্যে সূক্ষ্মার্থে আমরা অরাজকতারও ছাপ দেখিতে পাই। ট্রাম্প কার্ড যে সকল সময় উত্তম পক্ষের হাতেই থাকিবে, তাহা নহে। অন্য খারাপ পক্ষও তো ক্ষমতা পাইয়া ইহার অপব্যবহার করিতে পারে! কারণ, চাকু ডাক্তারের হাতেও থাকে, আবার ডাকাতের হাতেও থাকে। সুতরাং ‘নেসেসিটি নোউজ নো ল’—ইহা বলিয়া যে কোনো কিছু জায়েজ করিবার পূর্বে মুদ্রার অপর পিঠটি দেখিতে হইবে।