ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের জোশীমঠে ৭০০টিরও বেশি ভবনে বড়সড় ফাটল দেখা দেওয়ার পরে ওই রাজ্যেরই আরেকটি শহর কর্ণপ্রয়াগের অনেক বাড়িতেও ফাটল দেখা দিচ্ছে। জোশীমঠের বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত হওয়া ভবনগুলো থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।
কিন্তু কর্ণপ্রয়াগে এখনও সমীক্ষা চালানো হচ্ছে বলে প্রশাসন জানিয়েছে। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামীকে উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, জোশীমঠে ৭০০টি ভবন বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও ভেঙ্গে ফেলা হবে দুইটি বড় হোটেল ভবন।
তবে বিপজ্জনক বাড়িগুলোর বাসিন্দারা গত কয়েকদিন ধরেই ক্ষতিপূরণের দাবীতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। সরকার অবশ্য জানিয়েছে, এই আপদকালীন পরিস্থিতিতে প্রত্যেক পরিবারকে দেড় লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হবে, আর তাদের বাড়ি ও জমির বাজারদর হিসাব করে পরে পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে।
জোশীমঠ থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে কর্ণপ্রয়াগের তেহেশীলদার (স্থানীয় প্রশাসক) সুরেন্দ্র দেব সংবাদসংস্থা এএনআইকে জানিয়েছেন, বহুগুণা নগর এলাকার বেশ কিছু বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। কোন বাড়িগুলো সারানোর অনুপযুক্ত, সেগুলো চিহ্নিত করতে বুধবার তারা একটা সমীক্ষা চালিয়েছেন।
বাসিন্দাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে শুধু ওই বাড়িগুলো ভেঙ্গে ফেলা হতে পারে। এখনও পর্যন্ত তারা ২৭টি এরকম ভবন চিহ্নিত করতে পেরেছেন, যেগুলো আর সারানোর অবস্থায় নেই।
কর্ণপ্রয়াগের বেশ কয়েকজন বাসিন্দাকে উদ্ধৃত করে ইংরেজি সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, ২০১৩ সাল থেকেই সেখানকার বিভিন্ন বাড়িতে ফাটল দেখা দিতে শুরু করে, যা এখন বিপজ্জনকভাবে বড় হয়ে গেছে।
জোশীমঠ যে চামোলি জেলায় অবস্থিত, সেখানকার প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত একটি বুলেটিন জারি করছে। সর্বশেষ বুলেটিন অনুযায়ী, ৭২৩টি ভবনে বড় বড় ফাটল রয়েছে, যার মধ্যে ৮৬টি ভবন বিপজ্জনক এলাকায় অবস্থিত।
এছাড়া ১৪৫টি পরিবারের ৪৯৯ জন সদস্যকে অস্থায়ী শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিপজ্জনক এলাকায় প্রতিদিনই সমীক্ষা চালাচ্ছে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা সংস্থা। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরাও জোশীমঠেই অবস্থান করছেন।
যাতে যে কোনো বিপদ ঘটলে দ্রুত তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছিয়ে উদ্ধার কাজ শুরু করতে পারেন। বিপজ্জনক এলাকাগুলোর বাসিন্দারা ছাড়াও গোটা জোশীমঠের মানুষই আতঙ্কে রয়েছেন যে কখন না তাদের বাড়ি ভেঙে পড়ে। জোশীমঠের রাস্তা, হোটেল, সরকারি ভবন সব জায়গাতেই এখন বড় বড় ফাটল।
পাশাপাশি অবস্থিত দুইটি হোটেল কাত হয়ে একটি অন্যটির প্রায় গায়ে লেগে গেছে। বাসিন্দারা প্রশাসনের কাছে তাদের জন্য দ্রুত সহায়তার ব্যবস্থা করার আহবান জানিয়েছে। ভূ-বিজ্ঞানীরা লাগাতার সমীক্ষা চালিয়ে বলছেন জোশীমঠ শহরটা প্রতিদিনেই একটু একটু করে ডেবে যাচ্ছে।
এর একটা কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই শহরটা গড়ে উঠেছে এমন একটা ভূমির ওপরে যেটা আসলে একটা বহু প্রাচীন একটি ভূমিধসের কারণে জমা হওয়া মাটি, বালি আর পাথর।
ভূ-বিজ্ঞানী এস পি সতি বিবিসিকে জানিয়েছেন, জোশীমঠে দুই থেকে তিন ফিট চওড়া ফাটল দেখা যাচ্ছে। ওই ফাটলগুলো কতটা নীচ পর্যন্ত চলে গেছে, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে এই শহরটা একদিন মাটিতে মিশে যাবে। প্রাচীন ও আধ্যাত্মিক এই শহরের অস্তিত্ব আর থাকবে না।
একদিকে যেমন জোশীমঠ গড়ে উঠেছে ভূমিধসের ফলে জমা হওয়া মাটি, বালি আর পাথরের ওপরে, তেমনই শহরটির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকেও।
কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থা জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন যে তপোবন বিষ্ণুগড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করছে। তারই অঙ্গ হিসেবে একটা ১২ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ তৈরি হচ্ছে। এই সুরঙ্গ দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইনের জন্য জল নিয়ে যাওয়া হবে।
সুড়ঙ্গটির একটা অংশ জোশীমঠের মাটির নীচ দিয়েই গেছে বলে সেখানকার বাসিন্দাদের দাবী। তাদের কথায় ওই সুড়ঙ্গ তৈরির জন্য বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে, যার ফলে মাটির নীচে কোনো একটা জলপ্রবাহ হয়তো ফেটে গিয়ে শহরের নীচ দিয়ে কাদামাটিসহ জলপ্রবাহ প্রবল বেগে বইতে শুরু করেছে আর ওপরে শহরটা ধসে যাচ্ছে।
তবে প্রকল্প নির্মাণকারী তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন একটা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ওই সুড়ঙ্গটি টানেল বোরিং মেশিন দিয়ে খোঁড়া হচ্ছে এবং সেখানে কোন ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহার করা হচ্ছে না। এই বিবৃতি অবশ্য মানতে নারাজ জোশীমঠ বাঁচাও সংঘর্ষ সমিতির অ্যাক্টিভিস্ট অতুল সতি।
তিনি জানান, গত চার বছর ধরে টানেল বোরিং মেশিন মাটির নীচেই ফেঁসে আছে। এখন একটা বাইপাস টানেল তৈরি করা হচ্ছে আর সেখানেই বিস্ফোরকের ব্যবহার করা হচ্ছে।
সতি বলেন, আর তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশনের দায়িত্ববোধ কতটা সে তো আমরা ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারিতে তপোবন দুর্ঘটনার সময়েই দেখেছি। একশোরও বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছিলেন ওই ঘটনায়, বহু শ্রমিকের মৃতদেহ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি।'
ওই দুর্ঘটনার পরে সরকারের কথায় তিনিও গিয়েছিলেন তপোবনে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশনের কাছে সুড়ঙ্গর কোনো মানচিত্রই নেই।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ শেখর পাঠক জানিয়েছেন, হিমালয়, বিশেষত জোশীমঠ যে ধরণের আলগা মাটির ওপরে অবস্থিত, সেখানে বড় প্রকল্প নেওয়াই উচিত নয়। এই কথাটা বারে বারেই জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়াও বলেছে।
কিন্তু উন্নয়নের নাম করে সরকারগুলো সবসময়েই এধরণের সতর্কতাগুলোকে উপেক্ষা করে এসেছে। তারই ফল এখন ভুগতে হচ্ছে জোশীমঠের বাসিন্দাদের, এরপরে হয়তো সময় আসবে কর্ণপ্রয়াগের বাসিন্দাদেরও।