শুক্রবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

প্রবীণদের শারীরিক বিষয়ের না-বলা কথা বলতে হবে

আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০২:৩৫

এককালে আমরা ছিলাম দারিদ্র্যপীড়িত একটি জনপদের বাসিন্দা। আমাদের গড় আয়ু কম ছিল, সেজন্য প্রবীণও ছিল কম। ফলে একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে স্বল্প প্রবীণদের কাছে প্রবীণদের ব্যাপারে সচেতনতার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখন আমাদের দেশের গড় আয়ু বেড়েছে। সেই অনুযায়ী প্রবীণদের সংখ্যাও বাড়ছে দিনে দিনে। আমরা এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। সুতরাং আমাদের আর্থিক সামর্থ্য, শিক্ষিত প্রবীণের সংখ্যাও বাড়ছে। তবে শিক্ষা ও আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখনো আমাদের সমাজে প্রবীণদের বিবিধ সমস্যা নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সচেতনতা তৈরি হয়নি। সমস্যার অবশ্য শেষ নেই। এর মধ্যে প্রবীণদের দৈহিক সম্পর্ক নিয়ে বিশেষ কথা বলা যায় না। এ নিয়ে ট্যাবু আছে।

বর্তমানে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের বিয়ের গড় বয়স দিনে দিনে বাড়ছে। দাম্পত্য জীবনের নানা সংকট চ্যালেঞ্জ শিক্ষিত সচেতন ছেলেমেয়েদের চিন্তিত করে তুলেছে। ফলে অনেকে ত্রিশে এসেও বিয়ে করতে চাইছে না, বরং পরিবারের কাছে আরো কিছু দিন সময় চেয়ে বাবা-মায়ের কপালের বলিরেখা দীর্ঘ করে দিচ্ছে। বিবাহিত নর-নারীর বড় একটা অংশ বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই সঙ্গীর প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠেন। সন্তান-সন্ততি হওয়ার পর কারো কারো শারীরিক ও মানসিক দূরত্ব বেড়ে যায় এবং ক্রমেই যৌনজীবনে এর প্রভাব পড়ে। শারীরিক সম্পর্ক ঠিক না থাকলে দাম্পত্য জীবনে নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়। সুস্থ-স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্ক দাম্পত্য জীবনের অনেক কঠিন পরিস্থিতিকে সহজ করে তোলে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারী-পুরুষ উভয়েই বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক জটিলতার মধ্যে পড়েন, যার প্রভাব পড়ে সুস্থ দাম্পত্যের ওপর। শারীরিক কারণগুলো হলো ডায়াবেটিস, হৃদরোগ স্নায়ু রোগ, হরমোনে ভারসাম্যহীনতা, দুরারোগ্য ব্যাধি, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবন, অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ সেবন ইত্যাদি।

মানসিক কারণগুলো হলো কর্মস্থলে চাপা অস্থিরতা, পারিবারিক সংকট, সম্পর্কের জটিলতা, যৌন সক্ষমতা নিয়ে দুশ্চিন্তা, ডিপ্রেশন, অপরাধবোধ, সেক্সচুয়াল ট্রমা ইত্যাদি। এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা না থাকায় হারবাল কোম্পানিগুলো প্রতারণার সুযোগ বেশি পায়। বাজারের বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে কোনো ওষুধ সেবন কিংবা ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। এই সমস্যায় অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একজন বয়স্ক পুরুষ যত বেশি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবেন, তিনি তত বেশি স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবেন। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রবীণ হওয়ার আগেই নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে। ৩৮ বছর পার হলে পুরুষাঙ্গের রক্ত সরবরাহকারী ধমনি কিছুটা সংকুচিত হতে থাকে। উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল ইরেকটাইল ডিসফাংশন হওয়ার অন্যতম কারণ। নিজের ওজন যদি আদর্শ ওজনের চাইতে ২০ শতাংশ বেশি হয়, তবে অবশ্যই দ্রুত ওজন কমিয়ে আনতে হবে। শরীর চাঙ্গাকারী খাবার এড়িয়ে চলুন, বিশেষ করে ক্যাফেইন-সমৃদ্ধ খাবার। শরীর দারুণ ফিট মানে ইরেক্টাইল ডিসফাংশনের সম্ভাবনা কমায় না। শুধু নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে।

বিধবা, ডিভোর্সি, অবিবাহিত নারীর যৌন চাহিদা পূরণে বিয়ে একমাত্র বৈধ মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। তাদের অন্য কোনো উপায়ে বা মাধ্যমে যৌন চাহিদা পূরণে সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্র কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। যৌনকর্মে অক্ষম পুরুষের স্ত্রীর মানসিক কষ্ট লাঘবে সঙ্গীর ভূমিকা গৌণ। এই নারীরা নিন্দা এবং পাপের ভয়ে দিনের পর দিন যৌনমিলনের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এভাবে মধ্যবয়সি ও প্রবীণ নারীরা দিনে দিনে শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এটা স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্ককে অসুখী করতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিকভাবে নারী-পুরুষের চিন্তা-চেতনা, রুচি-সংস্কৃতি, দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশ কিছু পরিবর্তন চলে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মরত ও উচ্চশিক্ষিত নারীদের একটি অংশ শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। সাংসারিক চাপ, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে শারীরিক চাহিদার কথা অনেকেরই মাথায় আসে না। একটি জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ২৫ শতাংশ বয়স্ক নারী মনে করেন, বয়স বাড়লেও সুস্থ-স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্ক থাকা জরুরি। পুরুষ স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে তার মধ্যে বহুগামী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। সমাজ ও পরিবার-পরিজনের চাপের মুখে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ পথ এড়িয়ে চলেন। বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে পুরুষের ওপর আর্থিক নির্ভরতাও অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সমাজজীবনে অনেক বড় পরিবর্তন আনে। ‘শারীরিক সম্পর্ক কেবল পুরুষের একার বিষয় নয়’—লৈঙ্গিক সমতাপূর্ণ এই ভাবনাটা আমাদের সমাজে ক্রমশ প্রস্ফুটিত হচ্ছে। 

লেখক : প্রবীণবিষয়ক গবেষক

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন