বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের প্রতি আরও উদারতা প্রদর্শন করেছে। গত ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারিকৃত এক সার্কুলারের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে মামলা করার বিধান তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ হিসাব অবলোপন করার ক্ষেত্রে কোনো উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে না। এই নির্দেশনা প্রদানের আগ পর্যন্ত ২ লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ হিসাব অবলোপনের ক্ষেত্রে মামলা দায়ের করতে হতো না। এই নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে ঋণখেলাপিরা আরও কিছুটা স্বস্তি অনুভব করবেন। ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণ হিসাব অবলোপনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর একটি কৌশল মাত্র। ঋণ হিসাব অবলোপন শব্দটি উচ্চারিত হলেই ঋণের দাবি ত্যাগ করা বা ঋণ মওকুফ করে দেওয়ার মতো একটি আবহ আমাদের মনে দোলা দেয়। ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং এর রীতিনীতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত নন এমন অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, ঋণ হিসাব অবলোপন অর্থ হচ্ছে ব্যাংক তার পাওনা ঋণের দাবি পরিত্যাগ করেছে। আসলে বিষয়টি মোটেও তা নয়। ব্যাংক অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের কাছ থেকে কিস্তি আদায়ের আশা কখনোই পরিত্যাগ করে না। ঋণ হিসাব অবলোপনের অর্থ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট হিসাবের কাছে পাওনা খেলাপি ঋণকে ব্যাংকের মূল লেজারে প্রদর্শন না করে আলাদা হিসাবে সংরক্ষণ করা। ঋণ হিসাব অবলোপনের মাধ্যমে ব্যাংক তার মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ পায়। বিষয়টি অনেকটা এ রকম—এক ব্যক্তির তিন ছেলে। এর মধ্যে দুই জন সুস্থ-স্বাভাবিক। একটি ছেলে মানসিকভাবে অসুস্থ। বাইরে থেকে কোনো অতিথি এলে তিনি সুস্থ দুই ছেলেকে এনে তাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দেন। লোকলজ্জার ভয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ ছেলেটিকে ঘরে আড়াল করে রাখেন। এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে, মানসিকভাবে অসুস্থ ছেলেটি অস্তিত্বহীন। সে অস্তিত্ববান, কিন্তু প্রদর্শিত হয় না। এই অসুস্থ ছেলের প্রতি অভিভাবকের দায়িত্ব সুস্থ ছেলেদের চেয়েও বেশি। অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব অনেকটা মানসিকভাবে অসুস্থ সন্তানের মতো। এটা অস্তিত্ববান, কিন্তু প্রদর্শিত নয়। ব্যাংক অবশ্য সেই ঋণ হিসাবকেই অবলোপন করে, যেখান থেকে কিস্তি আদায়ের আশা ত্যাগ করা হয়। তাই অবলোপনকৃত ঋণ হিসাব থেকে কোনো কিস্তি আদায় হলে তা সরাসরি ব্যাংকের মুনাফা খাতে অন্তর্ভুক্ত হয়।
ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা জারি করা হয় ২০০৩ সালে। সেই আইন বা নীতিমালায় বলা হয়েছিল, কোনো ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের এবং শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ পূর্বক তা অবলোপন করা যাবে। অবলোপনকৃত প্রকল্পের ঋণ হিসাব ব্যাংকের মূল লেজারে প্রদর্শন না করে আলাদা হিসাবে সংরক্ষণ করতে হবে। অবলোপন করা হলেও সংশ্লিষ্ট ঋণ হিসাব থেকে কিস্তি আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। ঋণ হিসাব অবলোপন সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নতুন করে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন না। ২০১৯ সালে ঋণ হিসাব অবলোপনের নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়। এর মাধ্যমে ঋণখেলাপিদের অধিকতর সুবিধা দেওয়া হয়। নীতিমালায় বলা হয়, একটি ঋণ হিসাব মন্দমানে শ্রেণিকৃত হওয়ার পর তিন বছর অতিক্রান্ত হলেই তা অবলোপন করা যাবে। পাওনা ঋণের পরিমাণ ২ লাখ টাকা এমন ঋণ হিসাব অবলোপনের ক্ষেত্রে কোনো আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে না। একই সঙ্গে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফলে ঋণ হিসাব অবলোপন করা আগের চেয়ে অধিকতর সহজ হয়েছে। ঋণ হিসাব অবলোপনের নীতিমালার সুযোগে অনেকেই তাদের খেলাপি ঋণ হিসাব অবলোপন করিয়ে নিচ্ছেন। ঋণ হিসাব অবলোপনের ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদানের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরের অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি তথ্য প্রকাশ করেছে, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ, অবলোপনকৃত ঋণ যোগ করলে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৮১ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রদর্শিত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিশ্বাস করে না। তারা বলছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব প্রদর্শন করে, তাতে মামলাধীন প্রকল্পের কাছে পাওনা ঋণাঙ্ক, পুনঃ তপশিলিকৃত ঋণাঙ্ক বাদ দেওয়া হয়। এই দুই ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণ যুক্ত করলে ব্যাংকিং সেক্টরের প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে যাবে।
দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ একটি জটিল সমস্যা। প্রতিনিয়তই খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। আর কর্তৃপক্ষ নানাভাবে ঋণখেলাপিদের নৈতিক-অনৈতিক সুবিধা দিয়ে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছে। দেশের একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর এই প্রক্রিয়াকে ‘কার্পেটের নিচে ময়লা রেখে ঘর পরিষ্কার দেখানো’র চেষ্টা বলে উল্লেখ করেছেন। ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পেছনে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবই সবচেয়ে বেশি দায়ী। ব্যাংকারগণ যদি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করতেন, তাহলে খেলাপি ঋণ সৃষ্টির আশঙ্কা অনেকটাই কমে যেত। কারণ ব্যাংকিং আইনে এমন কিছু ধারা সংযুক্ত রয়েছে, যা প্রয়োগ করলে একটি প্রকল্পের অনুকূলে দেওয়া ঋণ সাধারণত খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু সেই সব আইনি ধারা সঠিকভাবে মেনে চলা হয় না। ব্যাংকার ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে একধরনের অনৈতিক যোগসাজশ সৃষ্টির মাধ্যমে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানের অনুকূলেও ঋণ বরাদ্দ করা হয়। আমাদের দেশে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের জন্য রাজনৈতিক ও আর্থিক ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। আবার ঋণখেলাপি হতেও একই রকম ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই এবং আর্থিকভাবে দুর্বল এমন কোনো উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে চাহিদামতো ঋণ পেয়েছেন এমন নজির নেই বললেই চলে। ঋণ প্রদানের সময় অনুধাবন করা যায় কোন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ভবিষ্যতে ঋণের কিস্তি আদায় করা যাবে আর কোনটির কাছ থেকে ঋণ আদায় করা যাবে না। যারা বৃহত ঋণখেলাপি, তারা বড়ই ক্ষমতাবান। তারা চাইলে ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য প্রচলিত আইন পরিবর্তন করতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে অভিজাত হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আইন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি আদায় করা যায়।
দেশের ব্যাংকিং সেক্টর খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। একজন উদ্যোক্তা তার প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে তা নিয়মিত পরিশোধ না করলে একসময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোক্তা ঋণখেলাপিতে পরিণত হন। গৃহীত ঋণের অর্থ তিনি কী করেন? তিনি কি এই অর্থ তার প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন? প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে তো দেশের অর্থনীতির চেহারা-চরিত্র পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। তাহলে এই ঋণের অর্থ কোথায় যাচ্ছে? চলতি মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। কয়েক মাস আগে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। বর্তমানে তা ১৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অর্থনীতিতে বিদ্যমান স্থবিরতা বিরাজ করা সত্ত্বেও ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের এই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু শিল্পায়ন বা বিনিয়োগ কি সেভাবে হচ্ছে? শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানির পরিমাণ কমেছে। তাহলে ঋণকৃত অর্থ কোথায় যাচ্ছে? অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করছেন, ব্যক্তি খাতে দেওয়া ব্যাংক ঋণ ও খেলাপি ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচারকৃত এই অর্থ আর কখনোই ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই। কারণ সরকার পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে কতটা আন্তরিক তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর কাছ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। সংস্থাটির পরিচালনা বোর্ডে ঋণদানের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কিছুদিন আগে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে ঋণের শর্তাদি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। সেখানে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বয়কট করার চিন্তা-ভাবনা করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? যারা ক্ষমতাবান এবং সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকেন, তারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হলেও কি তাদের আইনের আওতায় আনা যাবে? দেশের একজন বুদ্ধিজীবী বলেছেন, যারা ব্যাংকের অর্থ লুটে খায়, তারা কখনোই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী হতে পারেন না। ঠিক একইভাবে বলা যায়, যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তারা কখনোই দেশপ্রেমিক নাগরিক হতে পারেন না। তাই তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড