বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিবর্তনবাদ ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:৩২

বিবর্তনবাদ মানুষ ও বানরের পূর্বপুরুষ একই সাব্যস্ত করে। যা মুসলমানদের ইমানবিরোধী একটি কুফরি মতবাদ। বিবর্তনবাদ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তার ধারণা থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসা। বিবর্তনবাদ শুধু মানব সৃষ্টির উত্সকে অস্বীকার করে না। বরং আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রসহ সব সৃষ্টিরাজিকে মহান আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন—এই বিশ্বাসকেও অস্বীকার করে। কারণ, ডারউইন বা নব্যডারউইনদের বক্তব্য হলো, ‘সবকিছু প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি হয়। কেউ তার স্রষ্টা নয়।’

বিবর্তনবাদের অনুসারীদের মূল কথা হলো, আধুনিক মানুষ ও বানর... একটি সাধারণ প্রাইমেট জাতীয় প্রজাতি থেকে যাত্রা শুরু করেছে। প্রাইমেট জাতীয় প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে একদিকে শিম্পাঞ্জি, গরিলা (বানরের প্রকার) ... ধীরে ধীরে পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। ...এই বিকাশে লাখ লাখ বছর সময় লেগেছে। (নাউযুবিল্লাহ) এই থিওরিটি পবিত্র কোরআন ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের ইতিহাসের বিপরীত এবং পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মাবলম্বী মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলাম বিজ্ঞান চর্চা এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের বিরোধী নয়। বরং মানব কল্যাণে এগুলোর প্রতি উত্সাহিত করে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান হলো মানুষের গবেষণালব্ধ জ্ঞান। তা কখনো আসমানি জ্ঞান বা হাজার বছরের প্রমাণিত ইতিহাসের বিপরীত সত্য হতে পারে না। মানুষের গবেষণালব্ধ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো সাধারণত দুই ধরনের। একটি প্র্যাকটিক্যাল (প্রমাণিত সত্য) অন্যটি থিওরিটিক্যাল। প্র্যাকটিক্যাল আবিষ্কারগুলো কোরআন মাজিদের সঙ্গে বা প্রাচীন কোনো ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় না। যেমন—বিমান, রকেট, জাহাজ ইত্যাদি। আর থিওরিটিক্যাল গবেষণাগুলো সাধারণত কোনো কিছুর ওপর ভিত্তি করে ধারণামূলক হয়ে থাকে। এটি কখনো সত্য হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। আমরা অনেকেই বিজ্ঞানের এই থিওরিটিক্যাল তথ্যকে প্র্যাকটিক্যাল তথ্য বা আবিষ্কারের মতো চূড়ান্ত জ্ঞান মনে করি। যা ভুল চিন্তা ও মানসিকতা। এর উত্তম দৃষ্টান্ত হলো, মিশরের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লডিয়াস টলেমি বলেছিলেন, ‘সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে।’ অর্থাত্, পৃথিবী স্থির আর সূর্য তার চারপাশে ঘোরে। আজকের বিজ্ঞান কি তা বিশ্বাস করে? কক্ষনো না। অথচ ২৫০ বছর ধরে পৃথিবীর মানুষ এই মিথ্যা তথ্যকে বিশ্বাস করে আসছিল। যাদের মধ্যে আবার বড় বড় বিজ্ঞানী, গবেষকও ছিলেন। পরবর্তী সময় তার ঠিক বিপরীত থিওরি প্রকাশ করেন নিকোলাস কোপার্নিকাস, ‘পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘোরে’। অর্থাত্, সূর্য স্থির আর পৃথিবী তার চারপাশে ঘোরে। সূর্য ঘোরে না। তার এই থিওরিও বিজ্ঞান মহলে প্রায় ৫০ বছর বীরদর্পে টিকে ছিল। আজকের বিজ্ঞান কোপার্নিকাসের এই তথ্যকেও ভুল প্রমাণিত করে। বর্তমান বিজ্ঞানীরা বলেন, পৃথিবী ও সূর্য উভয়ই তাদের নিজস্ব কক্ষপথে ঘোরে। আর ১৪০০ বছর আগে কোরআন শরিফে সুরা ইয়াসিনে এটাই বলা হয়েছে, কুল্লুং ওয়া ফি ফালাকিই ইয়াসবাহুন। অর্থাত্ প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে ঘূর্ণিয়মান।

অনুরূপভাবে মানব জাতির ইতিহাস সম্পর্কে বিবর্তনবাদের এসব ধারণামূলক তথ্য চূড়ান্তভাবে বিবর্জিত। কারণ, ইতিহাস শাস্ত্রের মূলনীতিমূলক কথা হলো ইতিহাস কখনো ধারণানির্ভর হতে পারে না। প্রাচীন ও আধুনিক জ্ঞানসম্ভারের একটি মৌলিক উত্স হচ্ছে ইতিহাস। কেউ ইচ্ছে করলেই কোনো লজিক বা যুক্তি দিয়ে এই জ্ঞান উেসর ওপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখেন না। এই মহাবিশ্ব ও প্রাণিজগতের ইতিহাস দুটি অবস্থায় বিভক্ত; এক. মানব সৃষ্টির আগের ইতিহাস। দুই. মানব সৃষ্টির পরের ইতিহাস। উভয় অবস্থার প্রকৃত ও চূড়ান্ত ইতিহাস এই মহাবিশ্ব ও সব প্রাণিকুলের সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা  সঠিকভাবে জানেন। হ্যাঁ, মানব সৃষ্টির পরের ইতিহাস প্রত্যক্ষদর্শী কোনো ব্যক্তি বা দল থেকে যুগ শতাব্দীর ক্রমবিকাশে বংশ পরম্পরায় আমাদের কাছে পৌঁছতে পারে। কিন্তু মানব সৃষ্টির আগের ইতিহাস চূড়ান্তভাবে আমাদের কাছে মহান সৃষ্টিকর্তার সংবাদ ব্যতীত পৌঁছতে পারে না।

মানব জাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে মহান আল্লাহ তাআলা স্বয়ং নিজেই সৃষ্টি করেছেন। তিনি এই জাতিকে অন্য কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি করেননি।  আল্লাহ তাআলা আদি মানব আদম (আ.)-কে পানি ও মাটি মিশ্রিত শুষ্ক কাদামাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। এই উপাদানের কথা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের অনেক স্থানে বিভিন্ন বাচনভঙ্গিতে উল্লেখ করেন। ‘কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা’। (সুরা সাজদাহ:৭) ‘পোড়া মাটির মতো শুষ্ক মাটি’। (সুরা আর-রহমান:১৪) ‘আল্লাহ তাআলা তাকে (আদম) নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন’। (সুরা ছোয়াদ:৭৫) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘সে সময়কে স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের  বলেছিলেন, আমি শুকনো কাদার ঠনঠনে মাটি দ্বারা এক মানব সৃষ্টি করতে চাই। তাকে যখন পরিপূর্ণ রূপ দান করব, তখন তোমরা সবাই তার সামনে সিজদায় পড়ে যেও। সুতরাং সব ফেরেশতা সিজদা করল—ইবলিস ব্যতীত। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করল’। (সুরা হিজর:২৬-৩১)

অতঃপর আদম (আ.) থেকে তার স্ত্রী হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি করেন। (সুরা আ‘রাফ:১৮৯) অতঃপর আল্লাহ তাআলা আদম (আ.) ও স্ত্রী হাওয়া (আ.)-কে জান্নাতে বসবাস করার নির্দেশ দেন। তিনি কিন্তু তার হুকুম অমান্য করে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ায় আল্লাহ তাআলা আদম ও তার স্ত্রী হাওয়া এবং শয়তানকে পৃথিবীতে নেমে আসার নির্দেশ দেন। আর বলেন, তোমরা সেখানে জীবন যাপন করবে, সেখানেই তোমাদের মৃত্যু হবে। আর সেখান থেকেই তোমাদের পুনরায় জীবিত করে আখিরাতে উঠানো হবে। (সুরা আ‘রাফ:২৪-২৫)

দুনিয়াতে আদম ও হাওয়া (আ.) আসার পর আল্লাহ তাআলা তাদের উভয়ের পারস্পরিক মিলনের মাধ্যমে নতুন প্রক্রিয়ায় মানুষের বংশধারা চালু করেন। আর এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যুগ পরম্পরায় বংশানুক্রমিকভাবে বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের বসবাস। এই প্রক্রিয়ার মূল উপাদান হচ্ছে নারী-পুরুষের মিশ্রিত শুক্রাণু। যার বর্ণনা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেন—‘আল্লাহ তিনিই, যিনি তোমাদের এক ব্যক্তি (আদম) হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকেই তার স্ত্রীকে বানিয়েছেন, যাতে সে তার কাছে এসে শান্তি লাভ করতে পারে। তারপর পুরুষ যখন স্ত্রীকে আচ্ছন্ন করল, তখন স্ত্রী (গর্ভের) হালকা এক বোঝা বহন করল, যা নিয়ে সে চলাফেরা করতে থাকল’। (সুরা আ‘রাফ:১৮৯) ‘অতঃপর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন’। (সুরা নিসা:০১) মায়ের গর্ভে সন্তানের আকৃতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর তিনি তার (আদমের) বংশধারা চালু করেছেন নিঃসারিত তুচ্ছ পানি থেকে। তারপর তাকে (মায়ের গর্বে) সুষম করেছেন এবং তার (আল্লাহ) কাছ  থেকে তাতে রুহ (প্রাণ) সঞ্চার করেছেন। আর তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ। তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সুরা সাজদাহ:৮-৯, সুরা হজ্জ-৫) ‘তাদের দুজন থেকে অগণিত নারী-পুরুষ বিস্তার লাভ করেছে’। (সুরা নিসা:৪) আর তিনিই আল্লাহ—যিনি সুনিপুণ কারুকার্যের মতো মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। ‘অবশ্যই আমি মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর গঠনে সৃষ্টি করেছি’। (সুরা ত্বীন-৪)

এদিকে খ্রিষ্টান ধর্মের ধর্মীয়গ্রন্থ ‘পবিত্র বাইবেল’-এর পুরাতন নিয়ম (তাওরাত) অংশে ‘আদিপুস্তক’-এর প্রথম অধ্যায়ে ‘সৃষ্টির প্রথম মানুষ’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ঈশ্বর প্রথম মানব-মানবীকে সৃষ্টি করেন এবং তাদের পৃথিবীতে বংশবৃদ্ধির নির্দেশ দেন। (আদিপুস্তক- ১:২৬-২৮) ‘বাইবেল’-এর ‘পুরাতন নিয়ম’ অংশ ইহুদিদেরও ধর্মগ্রন্থ। তারাও উপরিউক্ত ইতিহাসই বিশ্বাস করে। হিন্দুধর্মের ‘বেদ’, ‘মহাভারত’ ও ‘উপনিষদ’-এর মধ্যে মানুষ ও সব সৃষ্টিরাজি মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনিভাবে প্রায় সব ধর্মের মানুষই এরূপ বিশ্বাস করে। সুতরাং, ‘বিবর্তনবাদ’ সব জাতি-ধর্মের মানুষের জন্য একটি বিষাক্ত ধর্মবিরোধী শিক্ষা।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

ইত্তেফাক/এসকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন