শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শিক্ষককে জুতাপিটা—কীসের আলামত?

আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৫:৩০

বরিশালের মুলাদীতে বিদ্যালয় মাঠে একজন শিক্ষককে জুতাপিটা করা হইয়াছে। কোনো শিক্ষককে কেহ যে এইভাবে সকলের সম্মুখে লাঞ্ছিত করিতে পারেন—তাহা মাত্র দুই-তিন যুগ পূর্বেও কল্পনা করা যাইত না। এখন প্রায়শই এই ধরনের সংবাদ আমাদের চোখে পড়ে। ইহা কীসের আলামত? গত শুক্রবার ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ হইতে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে আল শহিদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে আলোচনাসভা চলিতেছিল। একই সময় বেসরকারি সংস্থা সেইন্ট বাংলাদেশ তাহাদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষক নিয়োগের জন্য আলোচনা শুরু করেন। ঐ সময় শিক্ষক জাকির হোসেন মেধা যাচাইয়ের ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সেইন্ট বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন; কিন্তু স্থানীয় ফয়জুর রহমান টুলু তাহার এক আত্মীয়াকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিতে হইবে বলিয়া জানাইয়া দেন। সংস্থার নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে হইবে, নাকি মনোনীত মেয়েটি হইবে—ইহা লইয়া ফয়জুর রহমান টুলু এবং বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জাকির হোসেন বিতর্কে জড়াইয়া পড়েন। এক পর্যায়ে ফয়জুর রহমান কিল-ঘুসি ও চড়-থাপ্পড় মারিয়া শিক্ষক জাকির হোসেনকে জখম করেন, এমনকি সকলের সম্মুখে তাহাকে জুতাপিটাও করেন। বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষক ও স্থানীয়রা আহত শিক্ষককে উদ্ধার করিয়া মুলাদী হাসপাতালে লইয়া যান। এই ঘটনায় জাকির হোসেন বাদী হয়ে টুলুর বিরুদ্ধে মুলাদী থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়াছেন বটে, তবে একজন শিক্ষককে এইভাবে লাঞ্ছিত করিবার ঘটনাটিকে হালকা করিয়া দেখিবার অবকাশ নাই।

বলিবার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা এবং তাহাদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা একটি গর্হিত ও ক্ষমার অযোগ্য কাজ। কারণ, শিক্ষক হইলেন সমাজের নিকট আদর্শস্বরূপ। ফলে শিক্ষককে অপমান বা লাঞ্ছিত করিবার ঘটনা শিক্ষার্থীদের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেকে বলেন, পূর্বের শিক্ষকদের সহিত এই সময়ের শিক্ষকদের তুলনা চলে না। এখন অনেক ধরনের দলাদলি-রাজনীতি কাজ করে। প্রতিটি মানুষই কোনো বৈরী পরিবেশের সহিত খাপ খাওয়াইতে নানান কিছু করিতে বাধ্য হন; কিন্তু মনে রাখিতে হইবে—শিক্ষক তো শিক্ষকই। শিক্ষকরা হইলেন পিতৃতুল্য—এই জন্য শিক্ষকদের জীবনাদর্শ অনুসরণে একজন শিক্ষার্থী তাহার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করিয়া তোলেন। সুতরাং যেই সমাজে শিক্ষকদের অবহেলা ও অপমান করা হয়, সেই সমাজ অন্ধকারাচ্ছন্ন হইতে খুব অধিক সময় লাগে না। আমরা দেখিতে পাইতেছি, গত কয়েক দশক ধরিয়া অতি দ্রুত সামাজিক বিবর্তন ঘটিতেছে। সামাজিক এই বিবর্তন ভালো ও খারাপ—উভয়ই হইতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে খারাপের পাল্লা কখনো সখনো অধিক ভারী হইতে দেখা যায়। ইহা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। বৈশ্বিক নানান অস্থিরতায় আমাদের মধ্যে হতাশা বাড়িতেছে। কিছুকাল পূর্বে একটি বৈশ্বিক সমীক্ষায় বলা হইয়াছে, বিশ্বে অতীতের চাইতে বর্তমানে মানুষের রাগ, দুঃখ ও দুশ্চিন্তা বাড়িয়াছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালোপ পরিচালিত এই সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, বিশ্বব্যাপী দুঃখী ও রাগী লোকের সংখ্যা বাড়িয়াছে।

মানুষের দুঃখ-দুশ্চিন্তা বাড়িয়াছে—ইহার সরল অর্থ হইল মানুষের স্বস্তি কমিয়াছে, হতাশা বাড়িয়াছে। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, দুঃখ ও হতাশা হইতেই একজনের মধ্যে ক্রোধের উন্মেষ ঘটে। ফ্রয়েডের মতে, অন্যের প্রতি আক্রমণ মানুষের নিজের প্রতি ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তির এক রকম আত্মরক্ষামূলক আচরণ করিয়া থাকে মাত্র। আলবার্ট বান্দুরার মতো মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ব্যক্তির অনিয়ন্ত্রিত রাগ মূলত তিনি পরিবেশ হইতেই আত্মস্থ করেন। তবে এই বিষয়ে অন্যতম গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব দিয়াছেন জন ডোরাল্ড। তাহার ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেশন মতবাদ অনুযায়ী, রাগ মূলত মানুষের আশাভঙ্গ, নিষ্ফলতা, ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করিয়া সেই আশাভঙ্গ বা বিফলতার মাত্রা যদি গ্রহণযোগ্য না হয় বা ইহার মাত্রা যদি গভীরতর হয়। অন্যদিকে সাম্প্রতিক বিশ্বে যে অস্থির এবং অশান্তির বাতাবরণ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা প্রতিফলন ঘটিতেছে ব্যক্তিমানসেও। সুতরাং সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষক সমাজের কাহারো উপর হাত তোলাটা সামাজিক বিবর্তন ও পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির আলোকে দেখিতে হইবে। ইহা বিচ্ছিন্ন বিষয় নহে।

ইত্তেফাক/এমএএম