বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩, ১৫ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

নির্বাচন লইয়া গোলকধাঁধার অবসান কত দূর?

আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:২৬

যে কোনো রাষ্ট্রের জন্য তো বটেই, বিশেষ করিয়া উন্নয়নশীল ও অপেক্ষাকৃত নবীন স্বাধীন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ‘অনিশ্চয়তা’ শব্দটি দুশ্চিন্তার বড় কারণ। সরকার তথা ক্ষমতার পালাবদলের প্রশ্নে ইহা স্বাভাবিক যদিও; কিন্তু নির্বাচনের সময় ঘনাইয়া আসিলে তরুণ গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে ঘিরিয়া ধরে অনিশ্চয়তার জাল। কয়েক দশক পূর্ব হইতে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ‘নির্বাচন পদ্ধতি’। এই বিতর্কের ইতি টানা যায় নাই। কাহার অধীনে নির্বাচন হইবে—বিদ্যমান দলীয় সরকার নাকি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার—এই প্রশ্নের যুক্তিপূর্ণ সমাধান এখনো অমীমাংসিত। বলা বাহুল্য, মোটদাগে এই একটি মাত্র ইস্যুতেই আটকাইয়া রহিয়াছি আমরা। স্বাধীনতার অর্ধশত বৎসর পরও যদি নির্বাচন পদ্ধতি লইয়া এক জায়গাতেই চক্কর খায় রাষ্ট্র, তাহা হইলে বলিতে হয়, গণতন্ত্র সংহতকরণের প্রশ্নে চূড়ান্ত ও টেকসই সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইহা আমাদের বড় ব্যর্থতারই পরিচয়। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির মুখে একসময় ক্ষমতাসীন দল বিএনপি বলিয়াছিল, একমাত্র পাগল ও শিশু ছাড়া কেহ নিরপেক্ষ নহে। একইভাবে এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মৃত বলিতেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এই অবস্থায় আমাদের পর্যবেক্ষণ হইল—নিয়মিত, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হইলেও সফল গণতন্ত্রের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘অপরিহার্য’ শর্ত হইতে পারে না। বাস্তবিক অর্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ধারণা নিতান্ত একাডেমিক আলোচ্য বিষয়। যে কোনো নির্বাচন—তা সে যে পদ্ধতিরই হউক, নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের একটা প্রভাব রহিয়াই যায়। আবার কোনো কোনো সময় প্রার্থীর বিরুদ্ধে ডামি প্রার্থী দাঁড় করাইয়া ভোটকেন্দ্রে নিজের পক্ষের এজেন্ট বাড়ানোসহ নানাবিধ সুবিধা বাগাইয়া লইবার অভিযোগও উঠে। সুতরাং, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হইবে সেইটি বড় বিষয় নহে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই হউক কিংবা উন্নত রাষ্ট্রের নির্বাচনের বেলায়ই হউক, নির্বাচনে কমবেশি হট্টগোল সকল জায়গায়ই হয়। সেখানে জাল ভোট, ছাপ্পা ভোট, হট্টগোল, মারামারি ইত্যাদি যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হইতে দেখা যায়। তাহা হইলে আমরা যাইব কোথায়?

দুঃখজনক বিষয় হইল, যাহারা কখনো একটি ওয়ার্ডেও নির্বাচন করেন নাই, তাহারাই আজ নির্বাচন লইয়া সবক দিতেছেন। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাও যে ত্রুটিমুক্ত, তাহাও সত্য নহে বলিয়া প্রতীয়মান। বিশেষ করিয়া ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করে, তাহাও প্রশ্নের বাহিরে ছিল না। লক্ষণীয় বিষয় হইল, নির্বাচনের পূর্বে সর্বদাই হিসাবের বাহিরে থাকিয়া যাইতেছে ভোটারদের গুরুত্ব। বিদেশিদের প্রভাব লইয়াও আলোচনা হইতেছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হইতেছে, ভোটারদের আজ কেহ তেমন একটা আমলে নেন না। কেননা আমাদের ভোটারদের অধিকাংশই অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত। যাহাদের অনুদানের জন্য চেক দিলে তাহা নামকাওয়াস্তে মূল্যে বিক্রয় করিয়া দেন, তাহাদের নিকট হইতে ভোট ক্রয় করাটা কি কঠিন কিছু? একজন ভোটার অজ্ঞতার বশবর্তী হইয়া যখন অর্থের কাছে বিক্রি হইয়া যান, তিনি আন্দাজও করিতে পারেন না যে, দেশ ও জাতির কী মূল্যবান আমানত তিনি খোয়াইলেন! ইহাতে তাহাদেরকে দোষারোপ করাটাও অযৌক্তিক। কেননা যেই দেশে বিচারকদের অর্থের নিকট বিক্রি না হইবার জন্য সতর্ক করিবার কথা বলেন বিচারপতি, সেইখানে অশিক্ষিত-গরিব ভোটারদের ভোট বিক্রি করিবার বিষয়ে আর কিই-বা বলিবার থাকিতে পারে? যেইহেতু তাহাদের কিনা যায়, তাই তাহাদের লইয়া কেহ চিন্তিত নহেন।

এখন প্রশ্ন হইল, জাতীয় নির্বাচন লইয়া প্রতিবারই টানাহিঁচড়া চলিবে কেন? আমরা মনে করি, নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে অবশ্যই অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। একটি পারফেক্ট নির্বাচনের জন্য আমাদের অবশ্যই অপেক্ষা করিতে হইবে। ব্রিটেনের মতো আমাদের গণতন্ত্রের বয়স তো এত অধিক নহে। তাহা আবার নিরবচ্ছিন্নও ছিল না। আমাদের দেশে শিক্ষার হার ও আর্থিক সক্ষমতা যতই বাড়িবে, ততই আমাদের মধ্যে সচেতনা বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া আমরা মনে করি; কিন্তু নির্বাচন লইয়া কেন অনিশ্চয়তা ও গোলকধাঁধা থাকিবে? কবি বলিয়াছেন, ‘একবার না পারিলে দেখো শতবার।’ আমাদের নির্বাচন লইয়া যতই প্রশ্ন উঠুক, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনে শতবার চেষ্টা চালাইয়া যাইতে হইবে।

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন