চলমান বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বা বিপিএল আসরে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিবার কারণে ক্রিকেটের জাতীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তথা বিসিবির শাস্তি পাইলেন দারুণ ফর্মে থাকা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান নাজমুল হোসেন শান্ত। তিনি গত শনিবার এক ম্যাচে দলীয় ১১০ রানের মাথায় ৪৪ বলে ৬০ রান খেলিয়া আউট হন। এই সময় শান্ত বেশ অশান্ত হইয়া উঠেন। তিনি ক্ষোভে-দুঃখে নিজেই নিজের হেলমেট ও ব্যাট ছুড়িয়া মারেন। অতঃপর বিসিবির আচরণবিধির ২.২ ধারা তথা ক্রিকেট উপকরণের প্রতি অসম্মান কিংবা অব্যবহারের দায়ে তাহাকে তিরস্কারের পাশাপাশি তাহার নামের পার্শ্বে একটি ডিমেরিট পয়েন্ট যুক্ত করা হইয়াছে। তবে কোনো আর্থিক জরিমানা করা হয় নাই। সাধারণত তিনটি ডিমেরিট পয়েন্ট পাইলে তাহা সাসপেনশন পয়েন্টে রূপ নেয় এবং এই জন্য একজন ক্রিকেটারকে এক ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য যে শাস্তি দেওয়া হইয়াছে তাহা নিতান্ত নগণ্যই বলা যায়।
শাস্তি যতই নগণ্য হউক, ইহা আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। ক্রিকেটে আচরণবিধি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ইহার আগে সাকিব আল হাসান ও মোহাম্মদ আশরাফুলের ওপর শাস্তির খড়গ নামিয়া আসিবার দৃষ্টান্ত কাহারও অজানা নহে। বেচারা আশরাফুলের এই জন্য ক্যারিয়ারই ধ্বংস হইয়া গেল। বিশ্ব-ক্রিকেটসহ যে কোনো খেলায় বিখ্যাত ও ফরমে থাকা খেলোয়াড়দের শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য শাস্তি পাওয়ার ঘটনাও বলিতে গেলে অবিরল নহে। কিন্তু খেলাধুলার বাহিরের জগত তথা রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অহরহ শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ ঘটিতেছে। তবে তাহার জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে তেমন শাস্তি পাইতে হয় না। অথচ শৃঙ্খলা মানবজীবনের উন্নয়নের জন্যই অপরিহার্য। কোনো জাতি সর্বত্র শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় প্রদান ব্যতীত কখনো উন্নত জাতি হিসাবে মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারে না। কিন্তু বাঙালি জাতি হিসাবে এই ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা হতাশাজনক। আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শৃঙ্খলার চর্চা তেমন একটা করি না বলিলেই চলে। আমাদের অফিস-আদালত, সড়ক-মহাসড়কসহ কোথায় নাই বিশৃঙ্খলা? সড়কে চালকের বেপরোয়া মনোভাব, যত্রতত্র ওভারটেকিং, লাইসেন্সহীনতা, লাইসেন্স প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা, গাড়ির ফিটনেসের অভাব, রাস্তা সংস্কারের অভাব, রাস্তায় অবৈধ স্থাপনা, প্রয়োজনীয় সাইন-সিম্বল না থাকা, সাইন-সিম্বল থাকিলেও তাহা অমান্য করা, রোড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অভাব ইত্যাদি নৈরাজ্য তো আছেই। একই সঙ্গে অফিস-আদালতে যথাসময়ে উপস্থিত না থাকা, ফাঁকি দেওয়া, গরহাজির ইত্যাদির দৃষ্টান্তও কম নহে।
বস্তুত বিশৃঙ্খলা এই উপমহাদেশেরই একটি বড় সমস্যা। এতদঞ্চলে মোগল, ব্রিটিশসহ বিভিন্ন বিদেশি শক্তি দীর্ঘদিন শাসন করিলেও তাহাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করিবার বিষয়টি ছিল গৌণ। আবার বিদেশি শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে আমরা বারংবার বিদ্রোহ করিয়াছি। ইহাতেও শান্তি, স্থিতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হইয়াছে। অথচ প্রবাদে আছে, ডিসিপ্লিন ইজ ফার্স্ট বা শৃঙ্খলাই প্রথম। তবে আমরা মনে করি, আসলে ইহা হওয়া উচিত—ডিসিপ্লিন ইজ ফার্স্ট, ডিসিপ্লিন ইজ সেকেন্ড অ্যান্ড ডিসিপ্লিন ইজ লাস্ট। অর্থাৎ শৃঙ্খলাই প্রথম, দ্বিতীয় ও শেষ কথা। জনগণকে এই জন্য নিয়মকানুন মানিয়া চলিতে হইবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধনের দাবি তুলিতে হইবে। কিন্তু যতক্ষণ না তাহা সংশোধিত হয়, ততক্ষণ আমাদের আইনের মধ্যে থাকিয়াই কাজ করিতে হইবে। শুধু আপ্তবাক্য আউড়াইলেই চলিবে না, আমাদের কথা ও কাজের মধ্যে অবশ্যই সাদৃশ্য থাকিতে হইবে। বাংলাদেশে শৃঙ্খলা বিধানসংক্রান্ত যেই সকল আইন রহিয়াছে যেমন—সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা (নিয়মিত উপস্থিতি) অধ্যাদেশ ১৯৮২, ১৯৬৫ সালের কারখানা আইন, শ্রম আইন ইত্যাদি আমাদের মানিয়া চলা অত্যাবশ্যক। এই ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা ছাড়া আমরা কখনো উন্নতির সোপানে পৌঁছাইতে পারিব না।