‘আমাদের লক্ষ্য অর্জনে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সুগভীর পারস্পরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধা চাই। আদর্শ শিক্ষকের মাধূর্যমণ্ডিত চিত্র দেখতে পাই তার জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায়, ধ্যান ও ধারণায়, চিন্তা ও কর্মে, এমনকি আচরণ ও ব্যবহারে। এমন শিক্ষকই স্বভাবত তরুণ মন আকর্ষণ করেন। তার চারিত্রিক আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব ছাত্রের মনে রেখাপাত করলে জ্ঞান বিরকণ নিঃসন্দেহে সহজতর হয়ে ওঠে।’
১৯৭০ সালে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপাচার্যের ভাষণের প্রসঙ্গ এলেই আমরা কথার স্রোত বইয়ে দিই—না, এ দেশে অনুকরণযোগ্য কেউ নেই। প্রকৃতপক্ষে আমাদের চারপাশের সংকীর্ণদের দেখে ভুল করি। এই বাংলাদেশের সোনার মাটিতে কালে কালে অনেক প্রদীপ্ত ও সাহসী, সৎ ও নিষ্ঠাবান এবং অনুকরণীয় জনের জন্ম হয়েছে। কিন্তু অন্ধ ও বধিরেরা যেমন কিছু দেখে না, শোনে না, আমরা সেই কাল কাটাচ্ছি। নইলে এই বাংলাদেশে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নামে একটা বিশ্ববিদ্যালয়, নিদেনপক্ষে একটা হলের নাম থাকবে না? বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ই নয়, অনেক আগে থেকেই তিনি এই বদ্বীপের মানুষের জন্য কাজ শুরু করেছিলেন। ছিলেন অসম্ভব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। আবু সাঈদ চৌধুরীর পিতা আবদুল হামিদ চৌধুরী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের স্পিকার। অর্থাৎ, পারিবারিকভাবে তিনি অগ্রসর ছিলেন অনেক আগে থেকেই। যদিও ছিলেন শ্রেণিগতভাবে উঁচু শ্রেণির, কিন্তু আবু সাঈদ চৌধুরী সারা জীবন কাজ করেছেন সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ ও আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জনের পর আবু সাঈদ চৌধুরী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জুনিয়র হিসেবে আইন ব্যবসায় নামেন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল, ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। দেশ ও সমাজের প্রতি তীক্ষ মানবিক দৃষ্টির অধিকারী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সামনে চলে আসে ভয়াল ১৯৭১ সাল।
পাকিস্তানি জান্তা সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে তিনি তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করে সাধারণ জনতার কাতারে নেমে এলেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসে থেকে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহচর তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার বা বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রবাসী সরকারের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হয়। তিনি বুকের ওপর জনগণনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছবি নিয়ে দেশে দেশে সরকারের কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে থাকেন। অনেকের সঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে উঠতে থাকে। ফলে পাকিস্তানি হায়েনা সরকার বেকায়দায় পড়ে যায়। অন্যদিকে বাংলার মাটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে গড়ে তোলেন অনন্য প্রতিরোধ। সেই অকুতোভয় প্রতিরোধে ভেঙে পড়ে তথাকথিত অজেয় পাকিস্তানের নমরুদ সেনাবাহিনী। তারা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণ করে। হাজার বছরের সংগ্রাম আর লড়াইয়ের পর ৩০ লাখ বাঙালির প্রাণ আর ৫ লাখ নারীর পবিত্র ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জন করে পরম স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর পদে বরিত হলেন আর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হলেন প্রেসিডেন্ট। অজস্র প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছিল, কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, বিশ্বরাজনীতির কূটচালে বাংলাদেশ বিচলিত, তখন বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিলেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘আমি বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে আরো বেশি কাজ করতে চাই।’ হায়, যেখানে প্রত্যেকে ক্ষমতার তখ্ত আঁকড়ে ধরে মধু চাখতে চায়, সেখানে একজন অনন্য আবু সাঈদ চৌধুরী ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সাধারণে আসেন, এমন স্বজনবান্ধব আর কবে পাব?
‘স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি ও অন্যান্য’ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর রচনাসম্ভার। মনন ও মনীষায় সমৃদ্ধ বইটি সম্পাদনা করেছেন মাহবুব আজাদ। বইটির ভূমিকায় বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এক জায়গায় লিখেছেন—‘বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছিল সাহিত্য ও কবিতার প্রতি প্রবল অনুরাগ। তাঁর লেখায় ও বক্তৃতায় আমরা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতার চরণের সাবলীল ব্যবহার লক্ষ করি। তিনি জীবনে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সান্নিধ্যে এসেছেন। এই বিশিষ্টজনদের কয়েকজনের কথা লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে। তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন কী কী বৈশিষ্ট্য তাঁকে মুগ্ধ করেছে। এটা যেমন সত্য জ্যোর্তিময় গুহঠাকুরতা বা অমিয় চক্রবর্তীর বেলায়, তেমনি সত্য ড. এনামুল হক ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বেলায়ও। গুণগ্রাহিতা ছিল তার চরিত্রের একটি অঙ্গ। বিশিষ্টজনের কথা বলতে গিয়ে তিনি যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছেন।’
কালের পরিক্রমায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হারিয়ে গেছেন মরণপারে, কিন্তু আমাদের দায় তাকে সসম্মানে আমাদের মধ্যে জাগরুক রাখা। যাতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মানবকল্যাণে অনুপ্রেরণার অনুসন্ধান করতে পারে তার জীবন ও কর্ম থেকে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক