বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে শিশুনির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। আজকাল এ নিয়ে কারো যেন মাথা ব্যথা নেই। শিশুনির্যাতনের একটি হাতিয়ার হলো শিশু-পর্নোগ্রাফি। এ নিয়েও আমরা সচরাচর কথা বলতে দেখা যায় না। কিন্তু বিষয়টি আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এ ব্যাপারে আমাদের সবার সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। ভার্চুয়াল থেকে বাস্তব, সর্বক্ষেত্রেই এর রমরমা উপস্থিতি। করালগ্রাসী এই থাবা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হবে। কেননা এর গ্যাঁড়াকলে আমাদের সমাজব্যবস্থা আজ ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন।
বিশেষ করে ১৮ কিংবা এর কম বয়সি শিশুরা এর টার্গেট হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেড চিলড্রেনের (এনসিএমসি) ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে শিশু-পর্নোগ্রাফি তৈরিতে পঞ্চম বাংলাদেশ। তথ্যটি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ। শিশুদের যখন এ ধরনের কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয়, তখন সামগ্রিকভাবে শুধু একটি দেশ এবং জাতির উন্নয়নই বাধাগ্রস্ত হয় না, বরং এর মাধ্যমে দেশ ও জাতির উন্নয়নকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সাধারণত শিশু-পর্নোগ্রাফি বলতে ১৮ বছরের কম বয়সি শিশুকে ব্যবহার করে অশ্লীল ছবি থেকে শুরু করে অডিও-ভিডিও তৈরি করাসহ প্রচার ও সংরক্ষণ করা বা এজাতীয় কোনো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াকে বোঝায় (HA-World Law under book; volume 96)। এর ফলে একজন শিশু, বিশেষ করে কন্যাশিশুরা পিছিয়ে পড়ে। ছেলেদের ক্ষেত্রেও অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে প্রায়শই ফেরার পথ রুদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সঙ্গে সংগতি রেখে চলতে পারে না। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ তাদের কাছে স্বপ্নলোকের মতো হয়ে দেখা দেয়। তাদের জীবনে নেমে আসে বিভীষিকাময় এক অন্ধকার।
এর কলুষতায় শিশুরা শুধু শিক্ষা কিংবা স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অধিকার হারায়, তা-ই নয়; একই সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। বাঁধা পড়ে পুষ্টিহীনতার চক্রে। অনেক সময় শিশুকে জোরপূর্বক যৌনকর্মে বাধ্য করার লক্ষ্যে শরীরবর্ধক ওষুধ খাওয়ানো হয়। প্রাকৃতিক নিয়মের পরিবর্তে কৃত্রিম নিয়মে বা ওষুধের মধ্য দিয়ে তাদের শরীর বৃদ্ধি করানোর ফলে শিশুটি ধীরে ধীরে গুরুতর শারীরিক অসুস্থতার দিকে ধাবিত হয় এবং কৈশোর থেকে নারীত্বে পা দেওয়ার আগেই শারীরিক ও মানসিকভাবে অপমৃত্যু ঘটে। পাশাপাশি এর আওতায় ব্যবহৃত শিশুদের মাদক ও অস্ত্র পাচার কাজেও বাধ্য করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় চলতে চলতে একটা সময় শিশুটিও মাদকদ্রব্য গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মাদকাসক্ত শিশুরা মাদকদ্রব্য গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হয় না, এর উপজাত হিসেবে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্নমুখী অপরাধের সঙ্গেও।
শিশুদের প্রতি এরূপ নির্যাতন মানবতার চরম লঙ্ঘন। তারা প্রায়শ ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হয়। প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় এবং গোপনে বা বলপূর্বক অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বা ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করা হয়। এতে একসময় সেই কিশোরীরা চোখে দেখে সরষে ফুল। তারা হয়ে পড়ে দিশেহারা। এরপর আস্তে আস্তে তারা মানসিক ভারসাম্য হারাতে শুরু করে। এই যে পরিস্থিতি তা চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। কিন্তু এর দায় নেবে কে?
সাধারণত একজন কিশোরীর স্বপ্ন থাকে একটি স্বপ্নিল ভবিষ্যৎকে ঘিরে। এছাড়া চরম দরিদ্রতা, অল্প শিক্ষা, অন্যকে সহজে বিশ্বাস করা ও বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে অবলম্বন খোঁজার চেষ্টা করার কারণেও তারা এ ধরনের ফাঁদে পড়ে থাকে। তাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি কেবল নরপশুর মধ্যেই সীমিত নয়। এর শেকড় ও বিস্তৃতি অনেক গভীরে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনস্তত্বেই রয়েছে নারীকে নির্যাতনের নির্যাস।
বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ‘‘optional protocol to the convention on the rights of the children on the sale of children, child prostitution and child pornography (OPSC)’-এ স্বাক্ষর করে। এরই ধারাবাহিকতায় নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধকল্পে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ‘পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২’ (Pornography Control Act-2012) প্রণয়ন করে। এ আইনের ৮(৬) ধারায় শিশু-পর্নোগ্রাফির শাস্তিস্বরূপ সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের কথা বলা আছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এ আইন থাকার পরও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সদিচ্ছা ও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে পর্নোগ্রাফির নামে শিশুদের প্রতি এই নির্যাতন রোধ করা যাচ্ছে না। তাছাড়া এ আইন সম্পর্কে অনেকেই জানে না। আবার জানলেও সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে আইনের আশ্রয় নেয় না। তাই শিশু-পর্নোগ্রাফি ও নির্যাতন রোধে এ আইনের যথাযথ প্রয়োগের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। সমাজ থেকে হারিয়ে যাওয়া মূল্যবোধগুলোও ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিকদের আরো বেশি সচেতন হতে হবে, তৎপর হতে হবে। শুধু আইন করে এ অপরাধ দমন করা যায়নি, যাবেও না।
লেখক :উন্নয়নকর্মী ও সম্পাদক, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম