মঙ্গলবার, ২৮ মার্চ ২০২৩, ১৩ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

কঞ্চি-আগাছাদের বাড়াবাড়ি

আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:১৫

একটি সুন্দর, বসবাস উপযুক্ত এবং কল্যাণকর দেশ গঠনের লক্ষ্যে আমরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়াছি। সচেতন মানুষ মাত্রই বরাবরই খেয়াল করিয়াছেন যে, যখন যাহারা ক্ষমতায় আসিয়াছে, তাহারা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজেদের মতো করিয়াই সাজাইয়া থাকে। দুঃখজনক হইলেও সত্য যে, এই বিষয়গুলি ভারতীয় উপমহাদেশের খুব সাধারণ দৃশ্য। বাংলায় প্রবাদ আছে—বাঁশের চাইতে কঞ্চি দড়। কাষ্ঠল চিরহরিৎ উদ্ভিদ বাঁশ আসলে ঘাস পরিবারের বৃহত্তম সদস্য। কচি বাঁশের ডগা দিয়া তৈরি চিকন কঞ্চি। এই কঞ্চি যখন বাঁশের চাইতে বেশি শক্তি প্রদর্শন করিতে চাহে, তখন তাহাকে এককথায় ‘বাড়াবাড়ি’ কাজ বলা হয়। এই কঞ্চির যন্ত্রণায় তটস্থ সারা উপমহাদেশ। বলা হয় যে, আইন তাহার নিজস্ব গতিতে চলিবে, কিন্তু কঞ্চিরা ‘বাড়াবাড়ি’ করিয়া সেই আইনের পথ বাঁকাইতে ব্যস্ত থাকে। 

একটি অপূর্ব সুশৃঙ্খলা বজায় রহিয়াছে সমগ্র মহাবিশ্বে। বিস্ময়কর ভারসাম্য বজায় রহিয়াছে এই জগত জুড়িয়া!  মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, আত্মমর্যাদাবোধ দিয়া। আর তাহার পর সতর্ক করিয়াছেন বাড়াবাড়ি না করিতে। কিন্তু কথায় আছে—সূর্যের চাইতে বালির গরম বেশি। কিন্তু যাহারা বাড়াবাড়ি করেন, তাহারা ভুলিয়া যান, প্রকৃতি চিরকাল একই রকম থাকে না। কেন ঝড় উঠে—আমরা কি তাহা জানি না? বিজ্ঞান বলে, কোনো স্থানে বাতাস খুবই গরম হইয়া গেলে উহাকে ঠান্ডা করিতে ঝড় সৃষ্টি হইবেই। একইভাবে প্রতিনিয়ত বিশ্রী আর ভ্যাপসা গরমের দাপট মিলাইতে সাগরের বুকে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। আর বেশি বাড়াবাড়ি হইলে সেই নিম্নচাপ হইতে ভয়ানক ঝড় আসিয়া লন্ডভন্ড করিয়া দেয় সকল কিছু। চমকপ্রদ ব্যাপার হইল, ঝড় কখন সৃষ্টি হইবে কেহ বলিতে পারে না। আজকের ঝকঝকে নীল আকাশ দেখিয়া বুঝিবার উপায় থাকে না যে, কয়েক দিন পরও হানা দিতে পারে প্রবল কোনো ঝড়। অর্থাৎ প্রকৃতিতে অধিক উত্তাপ দীর্ঘকাল বজায় থাকিলে উহার ভারসাম্য আনিতে বড় ঝড় সৃষ্টি হইতেই হয়। এমনিভাবে মানবসমাজেও সকল কিছুর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সহ্যসীমা রহিয়াছে। ইলাস্টিকের যেন সহ্যের সীমা অতিক্রম করিলে উহা ছিঁড়িয়া যায়, তেমনি বিশ্বব্যাপী সমাজ-রাষ্ট্রে আমরা ইহার প্রতিফলন দেখিতে পাই প্রতিনিয়ত। 

প্রশ্ন হইল, এত কিছুর পরেও আমরা কেন বাড়াবাড়ি করিতে ভয় পাই না? প্রকৃতপক্ষে যাহারা যথার্থ জ্ঞানী, তাহারা নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি করিতে ভয় পান। অন্যদিকে যাহারা অপরিণামদর্শী, তাহারাই কেবল সীমা লঙ্ঘনের বিপদ অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হন। কারণ, কঞ্চিতুল্য কর্মীরা প্রতিনিয়তই ক্ষতি করিতে থাকে তাহার দলের। ইহাদের এককথায় ‘আগাছা’ হিসাবেও সম্বোধন করা যায়। আগাছার ক্ষতিকর দিকটি একটু খেয়াল করিলে দেখা যাইবে, উহারা যাহার রস-পুষ্টির ওপর ভাগ বসাইয়া ঝাড়েবংশে বাড়িয়া ওঠে, শেষাবধি তাহারা সেই মূল গাছটিকেই চারিদিক দিয়া ঘিরিয়া ফেলে। নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া ফেলে। ডিম ফুটিয়া বাহির হওয়া মাকড়সার বাচ্চারা যেমন মা মাকড়সার শরীর হইতে পুষ্টি লইয়া তাহাকে নিংড়াইয়া নিঃশেষ ও হত্যা করিয়া ফেলে, এই সকল আগাছাও তদ্রূপ। কথায় বলে—যেই ডালে বসিয়া আছ, সেই ডাল তুমি কাটিও না। কিন্তু এই আগাছারাও এক অর্থে নিজেদের বসিয়া থাকা ডালটিকেই কর্তন করিয়া থাকে, কারণ তাহার আরেকটা পা অন্য ডালে রহিয়াছে। জানিয়া-শুনিয়াই তাহারা এই কাজটি করে। বলা যায় ইহার জন্যই তাহারা ‘অ্যাসাইন্ড’। 

আগাছারা উহারা শুধু অনিষ্টকারীই নহে, উহারা একই সঙ্গে অতিমাত্রায় জন্মায়। উদ্ভিদ জগতেও দেখা যায়, আগাছারা সাধারণত অদম্য এবং অধিক বংশবিস্তারে সক্ষম। তাত্পর্যপূর্ণ ব্যাপার হইল, আগাছাদের জীবনচক্র স্বল্পমেয়াদি হইয়া থাকে। স্বল্পমেয়াদি হইলেও অল্প সময়ের মধ্যে উহারা যাহা ক্ষতি করিবার করিয়া ফেলে। সুতরাং সাবধান থাকিতে হইবে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও আগাছা হইতে। উদ্ভিদ-প্রাণিজগৎ ও মানবসভ্যতার ইতিহাস আমাদের নিকট এই সতর্কবার্তাই প্রদর্শন করে।

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন