ভারতের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ নামে একটি মার্কিন সংস্থা শেয়ার বাজারে ব্যাপক অনিয়ম ও হিসেবে কারচুপির অভিযোগ এনেছে । তারা যেসব অভিযোগ এনেছে তা খন্ডন করতে আদানি গ্রুপের আদানি শিল্পগোষ্ঠীর চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) যুগশিনদার সিং বক্তব্য দেন। তবে মার্কিন সংস্থা যা উপস্থাপন করেছে সেটিই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। খবর বিবিসি বাংলা।
যুগশিনদার সিং ভারতের একটি বিশাল তেরঙ্গা জাতীয় পতাকাকে পেছনে রেখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ওই বিবৃতিটি দিয়েছেন।
আর্থিক বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করা ব্লুমবার্গ এর ভাষায় “তাঁকে দেখে একটি কোনঠাসা ও অভিযুক্ত একটি কোম্পানির কর্মকর্তা মনে হচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল ভারত সরকারের তরফেই কেউ যেন বক্তব্য পেশ করছেন।”
ওই ভিডিও-বিবৃতির মধ্যে দিয়ে আদানি গ্রুপ যে বার্তা দিয়েছিল সেটাও পরিষ্কার। তিনি জানান, একটি বিদেশি সংস্থা (‘ফরেন এনটিটি’) যদি আদানিকে আক্রমণ করে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে তারা ভারতকেই নিশানা করতে চাইছে।
আসলে গত কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা ও আদানি শিল্পগোষ্ঠীর প্রসার যেরকম সমার্থক হয়ে উঠেছে, তার ভিত্তিতেই তারা এতটা জোরের সঙ্গে এই দাবিটা করতে পারছে।
এর পাশাপাশি এই তথ্যও ক্রমশ প্রকাশ পেয়েছে যে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও বিমা সংস্থাগুলোরও আদানি শিল্পগোষ্ঠীতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে।
ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) এবং বৃহত্তম বিমা সংস্থা লাইফ ইনশিওরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) এই তালিকায় অগ্রগণ্য। এসবিআই ও এলআইসিতে অ্যাকাউন্ট বা পলিসি নেই, ভারতে এমন পরিবার কার্যত নেই বললেই চলে।
হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট প্রকাশের পর আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন শেয়ারের দর যেভাবে হু হু করে পড়তে শুরু করেছিল, তাতে সেই এসবিআই ও এলআইসি-র লগ্নি দারুণভাবে বিপন্ন বলেও অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন।
ঠিক এই কারণেই অনেকে মনে করছেন, ভারতে ‘আদানি ইজ টু বিগ টু ফেইল’ – অর্থাৎ দেশে কোটি কোটি আমজনতার অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ এমনভাবে আদানি গোষ্ঠীর ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে আদানির কোনও বিপর্যয়, রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ‘অ্যাফোর্ড’ই করতে পারবে না।
কেন আর কীভাবে আদানি শিল্পগোষ্ঠী সাধারণ ভারতীয়দের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ, এই প্রতিবেদনে তারই উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে।
‘উত্থান অনিবার্য ছিল’
সুপরিচিত অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মিহির শর্মা মনে করেন, ভারত এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তাতে গৌতম আদানির মতো একজন ‘জাতীয় চ্যাম্পিয়নে’র উঠে আসা অবধারিত ছিল, যিনি অসম্ভব ঝুঁকি নেওয়ারও সাহস দেখাতে পারেন।
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বহু বছরের। সম্ভবত সে কারণেই গৌতম আদানি আজ এই জায়গাটায় পৌঁছেছেন, তিনি না-থাকলে এক্স, ওয়াই বা জেড অন্য কেউ একটা ঠিক এই জায়গাতেই আসতেন।”
তিনি বলেন, “এটাই আসলে হবার ছিল। আরও অনেক দেশের মতো ভারতও কিন্তু উন্নয়নের জন্য পুরনো ধাঁচের শিল্পনীতি প্রণয়নের রাস্তায় হেঁটেছে, বাজারকে সাপোর্ট করবে এমন কোনও কাঠামোগত সংস্কারের দিকে যায়নি। এই ব্যবস্থায় গৌতম আদানিদের জন্ম হতে বাধ্য,”
বস্তুত আজকের ভারতে বন্দর, রাস্তা, রেল, বিদ্যুৎ, এয়ারপোর্টসহ বৃহৎ অবকাঠামো খাতের সর্বত্র যেভাবে আদানি তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, তাতে তারা ভারতের অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
মিহির শর্মা আরও বলেন, “হিন্ডেনবার্গ কিন্তু এমন কোনও নতুন তথ্য দেয়নি যা ভারতের লগ্নিকারীরা জানতেন না। বহু বছর ধরেই তাদের জানা ছিল এই শিল্পগোষ্ঠীর যেটা ‘ফালক্রাম’, সেই আদানি এন্টারপ্রাইজেস দেনায় ডুবে আছে।”
“কিংবা আদানির অর্থায়নের উৎসটা যে খুবই অস্বচ্ছ, সেটাও অজানা কিছু নয়। তার পরেও তারা আদানিতে টাকা ঢেলেছেন, এসবিআই বা এলআইসিও কিন্তু আদানির ওপর ফাটকা খেলতে দ্বিধা করেনি।”