বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

৫০ হাজার বৎসর পর কোথায় থাকিব আমরা?

আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০১:২৮

হালকা সবুজ ধোঁয়ার মতো একটি ধূমকেতু পৃথিবীর নিকট দিয়া ক্রমশ মঙ্গল গ্রহের দিকে অগ্রসর হইয়াছে। ইহা সবচাইতে স্পষ্ট দেখা গিয়াছে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার, উত্তর তারা বা পোলারিস নামের নক্ষত্রের নিকটে। মহাকাশে ধূমকেতু যাইবে—ইহা লইয়া নূতন করিয়া বলিবার কী আছে? বিজ্ঞানীরা এখন অবধি ৫ সহস্রাধিক ধূমকেতুর সন্ধান পাইয়াছেন। তাহাদের ধারণা, ইহার সংখ্যা শতকোটিরও অধিক; কিন্তু আজ আমরা এই হালকা সবুজ রঙের ধূমকেতু লইয়া কথা বলিতেছি—তাহার কারণ এই ধূমকেতুটি আমাদের নিকট বিশেষ একটি বার্তা দেয়। বার্তাটি হইল—এই ধূমকেতুটিকে সর্বশেষ দেখা গিয়াছিল ৫০ হাজার বৎসর পূর্বে। তখন পৃথিবীতে ছিল প্রস্তর যুগ। মানুষ ছিল আদিম পর্যায়ে। সেই সময় আকাশে ধূমকেতু দেখা দিলে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষরা আতঙ্কে দিশেহারা হইয়া পড়িত। তাহাদের ধারণা ছিল—পৃথিবীর আকাশে ধূমকেতু দেখা দিলে দুর্ভিক্ষ, মহামারি, যুদ্ধবিগ্রহ বাড়িয়া যাইবে। এই তো মাত্র মধ্যযুগের দিকে মানুষের নিকট স্পষ্ট হইয়াছে—ধূমকেতুর ব্যাপারটি আসলে কী? সুতরাং ৫০ হাজার বৎসর পূর্বে এই সবুজ ধূমকেতুটি যখন পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান হইয়াছিল, তখন সেই আদিম মানুষেরা আতঙ্কে-ভয়ে সম্ভবত দিশেহারা হইয়াছিল। তখন পৃথিবীতে এখনকার মতো কৃত্রিম আলোর বন্যা ছিল না, ছিল না দূষণ। ফলে রাতের আকাশে ভয়ংকর রূপের ধূমকেতুকে দেখা যাইত খুব সহজেই।

আজি হইতে ৫০ বৎসর পর, ‘সি/২০২২ ই৩ (জেটিএফ)’ নামের এই ধূমকেতুকে পুনরায় দেখা যাইবে; কিন্তু ততদিন কি টিকিয়া থাকিবে মানবসভ্যতা? পৃথিবীতে প্রাণী থাকিবে নিশ্চয়ই; কিন্তু মানুষ কি নিজেদের মধ্যে ততদিন অবধি হানাহানি মারামারি ধ্বংসলীলা পার করিয়া অস্তিত্ব বজায় রাখিতে পারিবে? তখন কি এইভাবে এই ধূমকেতুকে লইয়া লিখিবার বা দেখিবার মতো কেহ থাকিবে? যেই পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র ও পরমাণু অস্ত্র জমা রহিয়াছে পৃথিবীতে, তাহা দিয়া বেশ কয়েক বার ধ্বংস করা যাইবে সম্পূর্ণ পৃথিবীকে। ৫০ হাজার বৎসরের মধ্যে এই পৃথিবীকে ধ্বংস করিবার মতো রসদ কমপক্ষে ৫০ হাজার গুণ বাড়িয়া যাইবে; কিন্তু মানুষ কি এমন হঠকারী হইবে—যাহারা নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুঠার মারিবে? নাকি কয়েক শত বৎসরের মধ্যে পৃথিবীতে ভয়ংকর ধ্বংসলীলা চলিবে, প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়িবে মানবসভ্যতা? অতঃপর সেই ধ্বংস হইতে কোনোরকমে টিকিয়া যাওয়া কিছু মানুষ নূতন করিয়া বিন্যস্ত করিবে মানবসভ্যতা? সেই সভ্যতা হইবে, অনেক অধিক যৌক্তিক ও শান্তিময়? আমরা জানি না; কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো আমরা এইটুকু অন্তত জানি—‘জগত জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি’। এই যে ভেদাভেদ, যুদ্ধবিগ্রহ, অশান্তি—ইহার নেপথ্যের কারণও আমরা জানি। আবার মানবজাতির ঐক্যের শক্তিও আমরা জানি। জগদ্বিখ্যাত টেলিস্কোপ জেমস ওয়েব ৪৬০ কোটি বৎসর পূর্বেকার অবস্থার ছবি প্রকাশ করিয়াছে কিছুদিন পূর্বে। এই জেমস ওয়েব চালু হইবার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলিয়াছিলেন—জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ তৈরির দাবিদার শুধু আমেরিকা নহে, পুরা মানবজাতি। তাহার কারণ হইল, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের উদ্যোগে শামিল হইয়াছিলেন পৃথিবীর ১৪টি দেশের সহস্রাধিক বিজ্ঞানী। সমগ্র বিশ্বের কয়েক হাজার বিজ্ঞানী যুক্ত হইয়া আক্ষরিক অর্থেই ইহাকে সমগ্র মানবজাতির সম্মিলিত একটি প্রকল্পে পরিণত করিয়াছে। ইহা মানবজাতির একতার দারুণ এক উদাহরণ। আধুনিক যুগে এখন আর আবিষ্কার ব্যক্তিকেন্দ্রিক নহে, সামষ্টিক। এই জন্য নূতন যুগে সাফল্যও আসিয়াছে বিস্ময়কর উচ্চতায়। সামষ্টিক গবেষণায় ১৯৯৫ সালে আবিষ্কৃত হইয়াছিল টপ কোয়ার্ক কণা। পদার্থের ক্ষুদ্রতম উপাদান হইল কোয়ার্ক। ইহা আবিষ্কারে আমেরিকার ফের্মি ন্যাশনাল অ্যাক্সিলারেটর ল্যাবরেটরিতে যোগ দিয়াছিলেন হাজারখানেক বিজ্ঞানী। ইহার পর ২০১২ সালে ঘোষিত হয় আর একটি কণা—হিগস বোসন, যাহার আরেক নাম ঈশ্বরকণা। এই গবেষণাতেও যোগ দিয়াছিলেন কয়েক হাজার বিজ্ঞানী।

সুতরাং সবুজ ধূমকেতু আর ৪৬০ কোটি বৎসর পূর্বেকার ছবি আমাদের সেই বার্তাটিই দিতেছে—কোথায় আমরা? কোথায়? ‘এক’ থাক, সাফল্য আসিবেই।

ইত্তেফাক/এমএএম