চলো চলো বইমেলাতে যাই, নতুন নতুন বইয়ের গন্ধ পাই। বইমেলা জ্ঞানের মেলা। আলোর মেলা। বই পড়লে মনের বাগানে আলোর ফুল ফোটে। যত রকমের মেলা হয়, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বইমেলা। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো বইমেলার নাম ‘অমর একুশে বইমেলা’। এই মেলাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর প্রকাশিত হয় হাজার হাজার বই।
স্বাধীনতার পূর্বে এদেশে বইমেলা নিয়ে সবার আগে চিন্তা করেন সরদার জয়েনউদদীন। তিনি ছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক। একসময় বাংলা একাডেমিতেও চাকরি করেছেন। তখন ‘Wonderful World of Books’ নামের একটি বই পড়ার সময় ‘Book Fair’ বিষয়টি তাঁর মাথায় আসে। কিছুদিন পর তিনি ইউনেস্কোর শিশু-কিশোর গ্রন্থমালা উন্নয়নের একটি প্রকল্পে কাজ করেন। ভাবনা ছিল, এগুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনী করবেন। কিন্তু প্রদর্শনী না করে আয়োজন করে ফেলেন শিশুগ্রন্থমেলা। মেলাটি বসে তত্কালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) নিচতলায়। ১৯৬৫ সালে। এটিই বাংলাদেশের প্রথম বইমেলা। এরপর তিনি ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহযোগিতায় একটি বইমেলার আয়োজন করেন। এই মেলার আলোচনা সভায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ আব্দুল হাই, শহিদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও সরদার ফজলুল করিম।
স্বাধীনতার পর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রথম বইমেলার সূচনা করেন শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের বটতলায় চট বিছিয়ে কিছু বই নিয়ে বসেন তিনি। বইগুলো আনা হয়েছিল কলকাতা থেকে। বইয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩২টি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ থেকে। যা পরবর্তীসময়ে ‘মুক্তধারা প্রকাশনী’তে পরিণত হয়।
শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা একাই প্রতি বছর বইমেলা চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৭৬ সালে কিছু প্রকাশক তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন। তারপর ১৯৭৮ সালে তখনকার বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বইমেলাকে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত করেন। তবে ‘বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’ এ মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৭৯ সালে। উল্লেখ্য, এ সমিতিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।
১৯৮৩ সালে মেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিয়েছেন বাংলা মায়ের বীর সন্তানেরা। সেইসব হার না মানা বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাঁদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য এরকম নামকরণ করা হয়েছে। ১৯৮৩ সালেই কাজী মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। মেলাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারিত হয় ২০১৪ সালে। আগে বইমেলা হতো ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ১৯৮৪ সাল থেকে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বাঙালির প্রাণের মেলা, অমর একুশে বইমেলা। লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের মিলনমেলা।
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন—বই, বই এবং বই’। টুপার বলেছেন, ‘একটি ভালো বই বর্তমান ও চিরকালের জন্য সবচেয়ে উত্কৃষ্ট বন্ধু’। বইমেলায় গিয়ে আমরা খুব সহজেই সংগ্রহ করতে পারি ভালো ভালো বই। অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের মেধাবিকাশের ক্ষেত্রে রাখছে অনন্য ভূমিকা।