কথায় আছে, ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়’। আমেরিকার আকাশে চীনের ‘গোয়েন্দা’ বেলুনের উপস্থিতিতেও বিশ্বে একই পরিস্থিতি তৈরি হইয়াছে। ইহা লইয়া এখন সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে টেনশন ও উদ্বেগ। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ বলিয়া আসিতেছেন যে, কিছুটা ভিন্ন প্রকারে হইলেও প্রতিশোধ লইয়া বিশ্বে আবার ফিরিয়া আসিতেছে কোল্ডওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ। সিরিয়ায় যুদ্ধ চলিবার সময় জাতিসংঘ পর্যন্ত এমন আশঙ্কা করিয়াছিল। তবে সর্বনাশা ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হইবার পর এখন অনেকেরই দাবি, বর্তমানে আসলে নীরবে ও নিঃশব্দে চলিতেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোটের মধ্যে চলা স্নায়ুযুদ্ধ কয়েক দশক ধরিয়া বিশ্বকে অস্থির করিয়া রাখিয়াছিল। ইহার অবসান হইয়াছিল ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র নামক দুই আদর্শের মধ্যে চলা এই দ্বৈরথ বন্ধ হইয়াছে বলিলে ভুল হইবে। কেননা স্নায়ুযুদ্ধের পর বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একমেরুকরণের যুগ শুরু হয়। ইহার পর মুক্তবাজার ও বিশ্বায়নের সুযোগ লইয়াই রাশিয়া ও চীনের নব-উত্থান ঘটিলেও তাহারা আসলে তাহাদের মূল আদর্শ হইতে এখনো অবিচ্যুত। বর্তমানে ইউক্রেন হইতেছে এই দুই মতাদর্শেরই নূতন লড়াইয়ের ময়দান। ফলে বিশ্ব হইতে টেনশন এখনো দূর হইতেছে না বা কমিতেছে না।
অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে উড্ডীয়মান ও সংবেদনশীল সামরিক স্থাপনায় নজরদারি করিতে থাকা সেই দৈত্যাকার চীনা বেলুনটিকে যুদ্ধবিমান এফ-২২-এর সাহায্যে গুলি করিয়া ভূপাতিত কর হইয়াছে। ইহার জেরে ইতিমধ্যে চীন সফর বাতিল করিয়াছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। অথচ কয়েক বৎসরের মধ্যে চীনে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে এই প্রথম শীর্ষ পর্যায়ের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হইতে যাইতেছিল। এমন সময় যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা গোয়েন্দা বেলুনের অনুপ্রবেশ একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন কান্ড ছাড়া আর কিছুই নহে। ইহা যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইনপরিপন্থি কাজও বটে। যদিও চীন দুঃখপ্রকাশ করিয়া বলিয়াছিল যে, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো এই বেলুন বাতাসে ভাসিয়া পথ ভুল করিয়া চলিয়া গিয়াছিল যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু একই ভুল লাতিন আমেরিকায় হয় কী করিয়া? কেননা সর্বশেষ খবর অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের মতো লাতিন আমেরিকার আকাশেও উড়িতেছে সন্দেহজনক চীনা গোয়েন্দা বেলুন।
আমরা জানি, গত বৎসর তাইওয়ানে মার্কিন হাউজের তৎকালীন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির আকস্মিক সফরকে কেন্দ্র করিয়া চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। চীনের সামরিক মহড়ার কারণে এক পর্যায়ে তাইওয়ানের নিকট পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন মার্কিন সপ্তম নৌবহর আসিয়া উপস্থিত হয়। এইরূপ উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিপাইন একটি নূতন সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়াছে। চুক্তির মূল বিষয় হইল, ফিলিপাইনের চারটি সামরিক ঘাঁটি হইতে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগর ও তাইওয়ানের আশপাশে চীনা তৎপরতার ওপর নজরদারি করা। ইহা ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি ও স্বাধীনতা রক্ষা করিবে বলিয়া আশা করা হইতেছে। উত্তরে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান হইতে দক্ষিণে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট যে চীনবিরোধী বলয় সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে, তাহাতে একমাত্র ফাঁক ছিল ফিলিপাইন। কিন্তু এই চুক্তির ফলে চীন ও মার্কিন বাহিনীর মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাতের দুইটি ফ্ল্যাশপয়েন্ট এখন তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরের সীমান্তবর্তী ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ। বেলুনকাণ্ডকে তাহারই পালটা ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচনা করা যাইতে পারে। ইহাতে বোঝা যায়, আমেরিকার মতো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার দেশেও চীন গোয়েন্দা নজরদারি চালাইতে সক্ষম।
মার্কিন আকাশে চীনা গোয়েন্দা বেলুন উড়াইবার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, কমিউনিস্ট বিশ্ব এখনো টেনশন জিয়াইয়া রাখিবার চেষ্টা করিতেছে। ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসন চালাইতেছে। আর তাইওয়ানে চীন আগ্রাসন চালাইবার চেষ্টা করিতেছে। ইহাতে শেষ পর্যন্ত কাহার লাভ-ক্ষতি, তাহা আমাদের মূল বিবেচ্য বিষয় নহে। এমনকি ভূপাতিত বেলুনের পরীক্ষানিরীক্ষা-সংক্রান্ত টেকনিক্যাল বিষয়েও আমাদের আগ্রহ কম। তবে আমাদের বক্তব্য হইল, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনিতেই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশসমূহ বেকায়দায় রহিয়াছে। তাহার ওপর এত উত্তেজনা ছড়ানো হইতেছে কেন? বিশ্বে এমন পরিস্থিতি তৈরি হইয়াছে যে, গরিব দেশগুলির ক্রমবর্ধমান সমস্যা লইয়া যেন কাহারো কোনো মাথাব্যথা নাই। অতএব, বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রতি আমাদের আহ্বান হইল—এমন ব্যবস্থা নিন, যাহাতে বিশ্বে টেনশন হ্রাস পায়।