তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার সংঘটিত ভূমিকম্প আমাদের মর্মাহত করিয়াছে। সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী দুই সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি হইয়াছে। ঘটিয়াছে ব্যাপক বিপর্যয়। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আক্ষরিক অর্থেই অত্যন্ত ভয়ানক। ভূমিকম্পটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, তুরস্ক ও সিরিয়া ছাড়াও লেবানন, সাইপ্রাস এবং ইসরাইল জুড়িয়া লক্ষ লক্ষ মানুষ ইহার কম্পন অনুভব করেন। এই ভূমিকম্পকে ১৯৩৯ সালের পর সবচাইতে বড় বিপর্যয় হিসাবে বর্ণনা করিয়াছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। শেষ রাতে ভূমিকম্প হইবার কারণে অধিকাংশ মানুষই তখন ঘুমাইয়াছিলেন। ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল তুরস্কের গাজিয়ানটেপ প্রদেশে, সেইখানে তাপমাত্রা মাইনাস ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেইখানকার এই অতি শীতল পরিবেশ স্বাভাবিকভাবেই উদ্ধারকার্যও কঠিন করিয়া তুলিয়াছে। এই দুর্যোগের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ভিডিও এবং ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে উঠিয়া আসিতেছে—যাহা দেখিয়া শিউরাইয়া উঠিতে হয়। স্মর্তব্য যে, তুরস্ক পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলির একটি। ইহার পূর্বে ১৯৯৯ সালে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের অধিক মানুষ নিহত হইয়াছিল। এই জন্য আশঙ্কা করা হইতেছে, এই বারের বিপর্যয় আরো মারাত্মক হইবে।
ভূমিকম্প কেন হয়, তাহার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময় দিয়াছেন। যদিও ভূমিকম্পের সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া অত্যন্ত কঠিন, তবে তুরস্কের এই ভূমিকম্পের পূর্বাভাস নাকি ইতিপূর্বেই দেওয়া হইয়াছিল। পবিত্র কোরআনে ‘ভূমিকম্প’ নামের একটি সুরা আছে। ইহার নাম হইল ‘আল-যিলযাল’। এই সুরায় বলা হইয়াছে—‘ভূমিকম্পের কারণে সমগ্র পৃথিবী কাঁপিয়া উঠিবে, আর সমস্ত বস্তু চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যাইবে।’ সুরা মুলকের সূচনায় বলা হইয়াছে—‘খালাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা...’ অর্থাৎ মহান আল্লাহ জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করিয়াছেন। আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করিয়া থাকেন নানাভাবে। ভূমিকম্পের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাহার বান্দাদের সতর্ক করেন, যাহাতে তাহারা অনুতপ্ত হয় এবং সতর্ক হয়। মহান আল্লাহ বলিয়াছেন, ‘আমি ভয় দেখাইবার জন্যই (তাহাদের নিকট আজাবের) নিদর্শনগুলি পাঠাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল :৫৯)। সুতরাং যখন কোথাও ভূমিকম্প হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয় কিংবা ঝোড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন মানুষের উচিত মহান আল্লাহর নিকট অতি দ্রুত তওবা করা।
দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করিয়া নেপাল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতে প্রায়শই ভূমিকম্প হইয়া থাকে। জানা যায়, বাংলাদেশেও টাইম বোমার মতো বড় একটি ভূমিকম্প অপেক্ষা করিতেছে। ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মিয়ানমার টেকটোনিক প্লেটের ভিতরে আটকাইয়া আছি আমরা। দেশি ও আন্তর্জাতিক ভূতত্ত্ববিদ এবং গবেষকরা ভূ-অভ্যন্তরের গঠন, ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত এবং কম্পিউটার মডেল বিশ্লেষণ করিয়া ইন্দোনেশিয়া ও চীনের পরই বাংলাদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছেন। তাহা ছাড়া আশঙ্কা করা হয় যে, বড় ভূমিকম্পগুলি সাধারণত শত বৎসর পরপর একই জায়গায় সংঘটিত হয়। আমাদের এই অঞ্চলে ১৮৯৭ সালে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার প্রলয়ংকরী ভূকম্পন হয়, যা ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ নামে বিখ্যাত। ঐ ধরনের কোনো দুর্যোগ এক্ষণে সংঘটিত হইলে আমাদের শুধু লাখ লাখ প্রাণহানিই হইবে না, পুরো দেশ হয়তো ইট-সুরকির তলে চাপা পড়িয়া থাকিবে। শত বৎসর পূর্বে ইমারতের বাড়াবাড়ি না থাকায় এবং এই অঞ্চল গ্রামভিত্তিক জনপদ হওয়ায় মহাবিপর্যয় তেমনিভাবে করাল থাবা বসাইতে পারে নাই; কিন্তু এক দশক পূর্বে কোনো ভূমিকম্প ছাড়াই বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে না মানায় রানা প্লাজায় যে দুর্যোগ নামিয়া আসিয়াছিল, তাহা আমাদের চোখে আঙুল দিয়া এই সত্যও প্রকাশ করিয়া দেয় যে, বড় ভূকম্পনে শতসহস্র ভবন ধসিয়া পড়িলে উদ্ধারকার্যে আমরা আক্ষরিক অর্থেই অসীম শূন্যে তাকাইয়া থাকা ছাড়া আর কিছু করিতে পারিব না। প্রাণহানি ও অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিই শুধু নহে, ভূমিকম্পের কারণে পরবর্তীকালে মানসিক স্থিতিশীলতাও নষ্ট হইতে দেখা যায়।
তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তে সংঘটিত এই ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য রইল আমাদের অশেষ সমবেদনা। ভূমিকম্পে নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করিতেছি।