শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও সিসিসীমা বিতর্ক

আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:১৭

মোটরসাইকেল তুলনামূলকভাবে একটি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা, উচ্চগতি—প্রভৃতি কারণে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়িয়াই চলিয়াছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) গবেষণায় বলা হইতেছে, প্রতি বৎসর বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাইতেছেন ২৮ দশমিক ৪ জন। তাহাদের প্রায় ৪০ শতাংশেরই বয়স ২৪ হইতে ৩০ বৎসর। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। যদিও মাথাপিছু মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান পিছনের সারিতে। বিশ্বে সর্বোচ্চ মোটরসাইকেল ব্যবহার করে ভিয়েতনাম। সেইখানে প্রতি ১ হাজার মানুষের বিপরীতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩৫৮টি। বাংলাদেশে ইহার সংখ্যা মাত্র সাতটি; কিন্তু দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার এই দেশেই সবচাইতে অধিক। এই দিক দিয়া দেশে যেইখানে মোটরসাইকেল ব্যবহার যথাসম্ভব নিরুত্সাহিত করা প্রয়োজন, সেইখানে যানজটসহ কিছু বাস্তব কারণে ইহার সংখ্যা বাড়িয়াই চলিয়াছে। যেমন—দেশ স্বাধীনের পর গত পাঁচ দশকে আমাদের দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা বাড়িয়াছে ৪৮ গুণ। এই পরিপ্রেক্ষিতে মোটরসাইকেলের সিসিসীমা বাড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত, তাহাও একটি বড় প্রশ্নই বটে।

বাংলাদেশে ২০১৭ সাল নাগাদ মোটরসাইকেলের সিসিসীমা ছিল ১৫৫। সেই বৎসর আগস্টে ইহা বাড়াইয়া করা হয় ১৬৫; কিন্তু মোটরসাইকেল আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী মহল ইহাতে সন্তুষ্ট নহেন। তাহারা এখন ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল আমদানির অনুমতি চাহিতেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলিতেছেন, দেশে ৫০০ সিসির মোটরসাইকেল আমদানি করা হইলে সড়ক দুর্ঘটনা আরো বাড়িয়া যাইবে। কেননা সিসির সঙ্গে গতির একটি সম্পর্ক থাকিবার ব্যাপারটি অনুপেক্ষণীয়। ব্যবসায়ী সমাজ দেশে অধিক সিসির মোটরসাইকেলের চাহিদা ও বিনিয়োগের বিষয়টিকে সম্মুখে আনিতেছেন; কিন্তু সড়কের নিরাপত্তার কথাও ভাবিতে হইবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বা বিআরটিএ একই কারণে ইহার বিরোধিতা করিতেছে। আবার পুলিশের পক্ষ হইতেও বলা হইতেছে যে, উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল অপরাধীদের হাতে পড়িলে তাহাদের অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়া যাইবে। অপরাধ করিবার পর তাহাদের দ্রুত ধরাও সম্ভব হইবে না। এইখানে বিআরটিএ ও পুলিশের যুক্তিকেও অগ্রাহ্য করা যায় না।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ২৪ এপ্রিল নূতন আমদানি নীতি আদেশে ৫০০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানি করিবার সুযোগ প্রদান করিয়াছে। ইহা দ্বারা যন্ত্রাংশ আমদানির মাধ্যমে দেশে উচ্চ সিসির মোটরসাইকেল দেশেই তৈরি করিতে পারিবে কোম্পানিগুলো। ইহা কি একটি সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত নহে? কেননা সরকার একদিকে বলিতেছে, ৫০০ সিসির মোটরসাইকেল আমদানি করিতে পারিবে না, অন্যদিকে পার্টস আমদানি করিতে পারিবে। আসলে এই বৈপরীত্যই নূতন বিতর্ককে উসকাইয়া দিয়াছে। যদিও বলা হইয়াছে, ৫০০ সিসির যন্ত্রাংশ আমদানি করা যাইবে শুধু মোটরসাইকেল তৈরি করিয়া রপ্তানির উদ্দেশ্যে; কিন্তু ইহাতে একসময় দেশেই তাহা বাজারজাতের যে দাবি উঠিবে তাহা কাহার অনুমান করিতে কষ্ট হইবার কথা নহে। আমরা মনে করি, এমন সিদ্ধান্তটিই হইয়াছে আত্মঘাতীমূলক। যতদিন না পুলিশের জন্য ৫০০-এর অধিক সিসিযুক্ত মোটরসাইকেলের আমদানি ও দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার উন্নতি হয়, ততদিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করাই কি শ্রেয় ছিল না? সড়কে কোন ধরনের যানবাহন কত সংখ্যায় চলিবে তা নির্ধারণ, মোটরসাইকেলের জন্য পৃথক লেন তৈরি, রোড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সংকট দূরীকরণ ইত্যাদি না করিয়াই ৫০০ সিসির মোটরসাইকেলের অগ্রযাত্রা শুরু হইলে সড়কে আরো বিশৃঙ্খলা যে তৈরি হইবে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। অতএব, এই ব্যাপারে যে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করাই বাঞ্ছনীয়।

ইত্তেফাক/ইআ