করোনা-পরবর্তী পৃথিবীটা কেমন যেন অপরিচিত হয়ে পড়েছে। জীবনে দীর্ঘ সময়ের এতগুলো দশক যা দেখেছি, যা শিখেছি, যেসব শিক্ষা আচরণকে স্বাভাবিক বা আদর্শ বলে দেখেছি-শুনেছি-শিখেছি এবং শেখাতে চেষ্টা করেছি, সব যেন মন থেকে ভেঙে পড়ছে আজ। সমাজটা যেন অচেনা হয়ে উঠছে। অচেনা হয়ে উঠছে চেনা সব লোক। মনে পড়ে শামসুর রাহমানের কবিতার অংশ—
‘কী যুগে আমরা করি বাস। প্রাণ খুলে কথা বলা/ মহাপাপ; যদি চেয়ার টেবিল কিংবা দরজার কানে গলা/ খাটো করে বলি কোনো কথা, তবে তারাও হঠাৎ/ যেন ব’নে যাবে বড় ঝানু গুপ্তচর। এমনকি গাছপালা,/ টিলা, নদীনালা/ কারুকে বিশ্বাস নেই বাস্তবিক। আমাদের এমনই বরাত।’
এটাই তাহলে আমাদের বরাত? কবিতাটি শামসুর রাহমান ১৯৭০ সালে লিখেছেন। ৫৩ বছর পর এখন পড়ে মনে হচ্ছে, এটা তো এই সময়েরই সবচেয়ে সত্য উচ্চারণ। কারণ এরপরের পঙিক্তমালায় কবি লিখেছেন : ‘কী যুগে করি আমরা বাস। এখন প্রতিটি ঘরে/ মিথ্যা দিব্যি পা তুলে রয়েছে ব’সে, প্রহরে প্রহরে/ পালটাছে জামা জুতো। সারাক্ষণ খাটছে হুকুম/ তারই ক্ষিপ্র ব্যস্ততায় পাড়ার মোড়ল, মজলুম।/ মহানুভবতা, প্রীতি ঔদার্য বিবেক সবই নিয়েছে বিদায় ছেলে-বুড়ো ঘুমোনো পাড়ার থেকে করুণ দ্বিধায়।’
কবি জানতেন না, আমরা যখন তপ্ত কড়াইতে ফুটছিলাম, সেখান থেকে তখন সময়ের তরিতে লাফ দিয়ে বর্তমানে এসে দাউ দাউ করে জ্বলা চুলার ভেতরে পড়েছি। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তথ্য বিস্ফোরণ ঘটেছে। নিশ্চয়ই অনেক সত্যকথনও প্রকাশ পাচ্ছে, কিন্তু মিথ্যার জঞ্জাল অনেক অনেক বেশি। সেসব জঞ্জাল আমাদের স্মার্ট ডিভাইসে এসে হামলে পড়ছে, আমাদের অসুস্থ করছে, ক্লান্ত করছে। উদাহরণের শেষ নেই। সামাজিক মিডিয়ায় অসামাজিক কার্যকলাপের দৃশ্য দেখে নিজের মধ্যেই আর্তনাদ করে হৃদয়। সেদিন হঠাৎ দেখতে পেলাম নোবেল পুরস্কারজয়ী অমর্ত্য সেনের ওপর বিশ্রী রকমের আক্রমণ। বিশ্বভারতীয় উপাচার্যের বক্তব্য শুনলাম। একটি রাজনৈতিক দলের সংসদ সদস্যের মুখে অমর্ত্য সেনের প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য এবং তার প্রকাশ করার ঔদ্ধত্য দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। রাজনীতি আর ক্ষমতার লোভ মানুষকে আজ কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে। এক মুহূর্তে আমরা একজন স্বনামধন্য বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বকে টেনেহিঁচড়ে নিচে নামাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছি না! যে ব্যক্তিগুলো এ ধরনের আচরণ করছে, তারা কি নিজেদের স্বার্থে এগুলো করছে, নাকি কারো বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার্থে সামান্য পদলোভ অর্থলোভ সাময়িক প্রচারের স্বার্থে সেব করছে? জাতির, সভ্যতার, ইতিহাসের সব শিক্ষা আর যুগে যুগে গড়ে তোলা বিশ্বাসকে যেন তারা এক নিমেষে ধুলায় মিশিয়ে দিতে চাইছে। কে বিশ্বাস করবে যে, অমর্ত্য সেন নাকি নোবেল পুরস্কার পাননি! তিনি নাকি বিশ্বভারতীয় জমি দখল করে আছেন! তার জীবনের সব অর্জন, সব শিক্ষা নাকি ভাঁওতাবাজি! পরে আরেকটি ভিডিওতে দেখলাম, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজে অমর্ত্য সেনের বাসায় গিয়ে অতীতে রাজ্য সরকারের দান করা দলিলের মূল কপি অমর্ত্য সেনের হাতে তুলে দিচ্ছেন। একই সঙ্গে ফেসবুকে যখন একপক্ষ অমর্ত্য সেনের ভাবমূর্তি-সম্মান ধুলোয় মেশাতে ব্যস্ত ছিল, তখন পাশাপাশি স্টকহোমে নব্বইয়ের দশকে অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার দৃশ্যও প্রচার হচ্ছিল।
প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন, “পৃথিবীতে এমন কোনো ‘মত’ জন্মাতে পারে না, যার পিঠ-পিঠ তার উলটো ‘মত’ না জন্মায়।” অর্থাৎ মত-এর পাশাপাশি ‘অমত’ও থাকবেই। কিন্তু আমরা যেন ‘মতামত’ মানতে পারি না। এই ‘অমর্ত্য’দের মতো গুণীদের এই মর্ত্যেই টেনেহিঁচড়ে নামাতে দ্বিধা করি না। হায় রে অদৃষ্ট! হায় রে বাঙালি! হায় রে দেশপ্রেম! হায় রে মানবতা! সত্য ও মিথ্যার এ কী ভয়ংকর খেলা! আমরাই-বা কথা বলি কোন সাহসে? জাতির পিতাকে কি পাকিস্তানিরা হত্যা করেছিল? না, তাকে হত্যা করেছিল এই স্বাধীন দেশেরই বাঙালিরা। ৫০ বছর পর ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার সুফল কতজন পেয়েছে? দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু ভাগ্যোন্নয়ন হয়েছে খুব অল্প কিছু মানুষের। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশটাকে নানান কর্ম-অপকর্মের মাধ্যমে কুরে কুরে খাচ্ছে লুটেরা গোষ্ঠী। ২০১৯-এর শেষে কোভিড নামের এক জীবাণু মানবসভ্যতাকে বিশ্বব্যাপী ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলল। পিতামাতা সন্তান একে-অপরের কাছ থেকে সংক্রমণের ভয়ে দূরে সরে গেল। আমরা রোগ এবং কোভিড নামক জীবাণু থেকে বাঁচতে গিয়ে জীবন থেকে পালাতে লাগলাম। কাছের লোকের সামনে নাকে কাপড় দিতে অভ্যস্ত হলাম। সব ধর্ম-ভালোবাসা-আন্তরিকতা আর মানবতার স্থান দখল করল ‘মহামারি’ নামক শব্দ। এই মহারোগ জন্ম দিল সমাজে স্বার্থপরতা ধর্ম, নির্দয় হওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’—এই প্রবাদ প্রমাণিত আজ। কাজেই অর্থসম্পদ নিয়ে জান বাঁচানো ফরজ। হাজার হাজার টাকার বিনিময়ে রোগনির্ণয় এবং তার ওষুধ ক্রয়ের প্রক্রিয়া।
শামসুর রাহমানের কবিতাটির আশ্রয় নিই আরেকবার। ১৯৭০ সালে মহামারি ছিল না। কিন্তু কবিরা সম্ভবত সভ্যতার অন্তর্যামী। তিনি সেই সময় লিখেছেন :‘...মহামারি দিগ্বিদিক মাথায় টোপর/ প’রে ঘোরে সর্বক্ষণ।/ আমাদের সন্তানের দোলনা দুলছে মৃদু ছন্দে/ অসংখ্য লাশের ঘুম-তাড়ানিয়া উৎকট দুর্গন্ধে।’
ধীরে ধীরে মানুষ কখন যে অমানুষ হয়ে যাচ্ছে, আমরা নিজেরাও জানি না। একটা মোবাইল ফোন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আজ। গরিব-দরিদ্র না-খাওয়া, বিত্ত বা বিত্তহীন যে নামেই ডাকি তোমায় সেলফোন ছাড়া তুমি মূল্যহীন। এই মোবাইল তোমার চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ করে। উন্নয়ন বলতে আমরা আজ প্রযুক্তিই বুঝি। এর উপকারিতা প্রচুর। কিন্তু আসল ও নকল খবরের ধাক্কায় সাধারণ মানুষ বেসামাল। জীবনযুদ্ধে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস।
যারা একসময় সমাজে মাথা উঁচু করে থাকত, তাদের অবস্থাও যেন ক্রমে নাজুক হয়ে পড়ছে। আর্থিক নাজুক এবং সামাজিক নাজুকের মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। প্রযুক্তি ও আর্থিক এবং প্যান্ডামিকের সঙ্গে যখন পশ্চিম বিশ্বের পরাশক্তিগুলো তাদের ইগো এবং ক্ষমতার দম্ভের প্রতিযোগিতারত তখন মানচিত্রের নিচের দিকের দেশগুলো তার খেসারত দিতে দিশাহীন। তারই প্রতিক্রিয়ায় সবার রাষ্ট্রক্ষমতার ধারেকাছে থেকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় যা করছে তারই আউটকাম বোধ হয় অমর্ত্য সেনের মতো লোকদের অবমাননা। কারণ অস্তিত্বের জগিট এত ভঙ্গুর যে আদর্শ বা তিলে তিলে গড়া যে সভ্যতা, তা আজ বর্তমানের চাহিদার কাছে নগণ্য। ঠিক যেমন পরিবেশ আজ বিপন্ন। কিন্তু প্রকৃত মর্মবোধ কজনের আছে! সবাই ভুক্তভোগী; কিন্তু কেউ তার এতটুকু স্বার্থ বিসর্জন দেবে না। গাছ কাটলে ক্ষতি, তবে জ্বালানি আসবে কোথা থেকে? পাহাড় কাটলে, নদীর খালবিল ভরাট করলে পরিবেশের বিপর্যয় হয়। কিন্তু নদীশাসন না করলে ব্রিজ কালভার্ট বা জমি দখল করে হাউজিং বা রিজার্ভ-ব্যবস্থা হবে কী করে? রাস্তা না বাড়ালে গাড়ি উৎপাদনকারী দেশগুলোর ব্যবসা কোথায় যাবে? প্রতিটা কারণ একে-অন্যের সঙ্গে ল্যাপটালেপটি করে আছে। ঠিক যেমন মোবাইল ফোন। ২০১০-এর পর এর ব্যবহার যেমন উপকার করেছে, তেমনি করেছে প্রভূত অপকারও। কারণ আমরা সমতা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমাদের পরিমিতি বোধ কম। এজন্য আমাদের আচার-ব্যবহারে পরিমিতি বোধের অভাব, মানবতায় সমতার অভাব। সমতাহীন সমাজ রাষ্ট্রের সমতা বা ব্যালেন্সও রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। গণতন্ত্রও সেখানে ব্যর্থ। এজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সমাজ প্রবন্ধে বলেছেন—‘সরলরেখা আঁকা সহজ নহে, সত্য বলাও সহজ ব্যাপার নহে।...আমরা যখন মিথ্যাপথে চলি, তখন আমরা দুর্বল হইয়া পড়ি এইজন্য। তখন আমরা আত্মহনন করি। তখন আমরা একেবারে আমাদের মূলে আঘাত করি।’
তাই বোধহয় আমরা আজ নিজেদের চিনতে জানতে ব্যর্থ হচ্ছি। সত্য নাকি নগ্ন। এ কারণে সত্যকে লুকিয়ে রাখলে তো হবে না। মিথ্যা যখন চারদিকে ছড়ি ঘোরায় আর ‘সত্য’ প্রকাশে আমরা যদি চুপ করে বসে থাকি, তখন মিথ্যাই সত্যের রূপ ধারণ করে ঘুরে বেড়াবে। সত্যকে না চিনলে মানুষ মিথ্যাকেই সত্য মনে করবে। সুতরাং মিথ্যাকে দিব্যি পা তুলে বসে থাকতে দেওয়া যাবে না। নাকি দিতেই হবে?
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক