বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩, ১৬ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

তুরস্ক-সিরিয়ায় কেন এত শক্তিশালী ভূমিকম্প?

আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৪:২৪

তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং সিরিয়ার উত্তরে সোমবার ভোরে আঘাত হানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। গত এক দশকের মধ্যে এটিকে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা। খবর ডয়চে ভেলে। 

ভূকম্পনবিদরা বলছেন, দশকের অন্যতম শক্তিশালী এই ভূমিকম্পের ফলে তুরস্কের আনাতোলিয়া থেকে আরব ভূখণ্ড পর্যন্ত মাটির গভীরে ১০০ কিলোমিটারের (৬২ মাইল) মতো দীর্ঘ ফাটল তৈরি হয়েছে। মাটির নিচে আসলে কী ঘটেছে এবং এর প্রভাব কী তা-ও ব্যাখ্যা করেছেন তারা।

উল্লেখ্য, ভূমিকম্পে দুই দেশে মৃতের সংখ্যা এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৮০০ ছাড়িয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। তুরস্কে নিহতের সংখ্যা ৫ হাজার ৮৯৪ এবং সিরিয়ায় ১ হাজার ৯৩২ জন বলে নিশ্চিত করেছে দুই দেশের কর্তৃপক্ষ। ৩৪ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

এই ভূমিকম্পের উৎপত্তি কোথায়?

সোমবার ভোরের ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে গাজিয়ান্তেপ প্রদেশের নুরগাদি শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার পূর্বে এবং ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে ইস্ট আনাতোলিয়া ফল্টে। ফল্ট বলতে মাটির নিচে পাথর ও অন্যান্য খনিজের বিশালাকৃতির (শত বা হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ) খণ্ডগুলোকে বোঝায়। অনমনীয় এই প্লেটগুলো চলমান অবস্থায় থাকে।  

ইস্ট আনাতোলিয়া ফল্টে ফাটলের কারণে সৃষ্ট কম্পনগুলো উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবল ছিল। এর ফলে তুরস্কের মধ্যাঞ্চল ও সিরিয়া পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি ছড়িয়ে গেছে।

ব্রিটিশ জিওলোজিক্যাল সার্ভের অনারারি রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট রজার মুসন বলেন, গত শতাব্দিতে ইস্ট আনাতোলিয়া ফল্টের তেমন কোনো গতিবিধি ছিল না। ১৯৭০ সাল থেকে এই ৫২ বছরে এই এলাকায় তিন বার রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। কিন্তু এখন থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ১৮২২ সালে এই এলাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে অন্তত  ২০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়।    

কত ভয়ঙ্কর ছিল এই ভূমিকম্প?

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এক বছরে মোটামুটি ২০টির কম ভূমিকম্প ৭ মাত্রার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়। তবে কী পরিমাণ শক্তি এই ভূমিকম্পের ফলে বিচ্ছুরিত হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।

ইউনভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যান্ড ডিজাস্টার রিডাকশনের প্রধান জোয়ান্না ফাউর ওয়াকার জানান, ২০১৬ সালে ইতালিতে ৬ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৩০০ জেনের প্রাণহানি ঘটে। সেই তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল তুরস্কের এই ভূমিকম্প। গত ১০ বছরে এত শক্তিশালী মাত্র দুটি ভূমিকম্প হয়েছে পৃথিবীতে।

কেন এত প্রবল কম্পন?

ভূপৃষ্ঠের নিচে ইস্ট আনাতোলিয়া ফল্ট দুই অংশে ভাগ হয়ে দুটি খণ্ড আগু-পিছু অবস্থায় সরে গেছে, বলছেন ভূকিম্পনবিদরা। পাথুরে এই খণ্ডগুলো পরস্পরকে ধাক্কা দিতে দিতে একটি ওপরের দিকে ও একটি নীচের দিকে সরতে থাকে। এসময় প্রবল মাত্রার শক্তি নির্গত হয়। দুটি খণ্ডের মাঝখানে দূরত্ব তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এই অবস্থা চলতেই থাকে। এ কারণেই এত শক্তিশালী ভূকম্পন অনুভূত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার নিচে দ্য সান অ্যান্ড্রিয়াস ফল্ট একই ধরনের, তবে সবচেয়ে শক্তিশালী স্ট্রাইক স্লিপ ফল্ট বলেও জানান বিজ্ঞানীরা। সেখানে যে কোনো সময় ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প আঘাতের পূর্বাভাস দীর্ঘদিন ধরেই দিয়ে রেখেছেন তারা।
ব্রিটেনের ওপেন ইউনিভার্সিটির ভূতত্ত্ববিদ ডেভিড রটারি বলেন, ফল্টে ফাটল যত গভীর হবে, ভূমিকম্প ততই শক্তিশালী হবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে তুলনামূলক অগভীর ফাটল থেকে তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্প হয়েছে।

কী রকমের আফটারশক হতে পারে?

৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার ১১ মিনিট পর ওই একই এলাকায় ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। দুপুরের দিকে আঘাত করে ৬ মাত্রার কম্পন। 

ব্রিটিশ জিওলোজিক্যাল সার্ভের রজার মুসন বলছেন, আনাতোলিয়া ফল্টের আশপাশের ফল্টগুলোর গতিবিধির কারণে এসব আফটার শক হচ্ছে। এই অবস্থা আরও কিছু দিন চলতে পারে।

১৮২২ সালের ভূমিকম্পের পর প্রায় এক বছর পর্যন্ত তুরস্কের ওই এলাকায় প্রায়ই ভূমিকম্প অনুভূত হতো বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।

মৃতের সংখ্যা কত হতে পারে?

জনবহুল এলাকায় একই মাত্রার ভূমিকম্পে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। ২০১৫ সালে নেপালে ৭ দশমিক ৮, অর্থাৎ একই মাত্রার ভূমিকম্পে ৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। 

তুরস্ক ও সিরিয়ার পরিস্থিতি ভালো নয় এবং তীব্র শীতের কারণেও মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

ইত্তেফাক/এফএস