‘আজকের শিশু আনবে আলো, বিশ্বটাকে রাখবে ভালো’—মুখে এই ধরনের নানা কথা বলা হয় বটে; কিন্তু কোমলমতি শিশুদের সকল ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা কি যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়া থাকি? যদি শিশুদের লইয়া আমাদের মুখের বুলির সহিত কৃতকর্মের সত্যিই মিল থাকিত, তাহা হইলে সমুদ্রের বুকে জেলের নৌকায় দুধের শিশুকে দেখিতে হইত না! দিন কয়েক পূর্বে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় কলাগাছিয়া নদীতে ছোট্ট শিশুসহ একটি জেলে পরিবারের মাছ ধরিবার ঘটনা দৃষ্টিগোচর হইয়াছে আমাদের। বলা বাহুল্য, প্রতিকূল আবহাওয়া সত্ত্বেও অসুস্থ শিশুটিকে মাছ ধরিতে লইয়া যান বা যাইতে বাধ্য হন স্থানীয় মান্তা সম্প্রদায়ের এক দম্পতি। মত্স্যশিকারিদের সমুদ্র বা উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে প্রাণহানিসহ দুর্ঘটনা-দুর্বিপাকে পড়িবার খবর শুনিতে পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়। এই বিচারে দুধের শিশু লইয়া সমুদ্রে মাছ ধরিবার আশু বিপদ সম্পর্কে ভাবিলেও শিহরিত হইতে হয়! প্রশ্ন তোলা যায়, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে দায়িত্বরত কোস্ট গার্ড, নৌপুলিশ তথা নিরাপত্তাকর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়া দুধের বাচ্চা লইয়া মাছ ধরিতে সমুদ্রে প্রবেশ সম্ভব হইল কীভাবে?
উল্লেখ করা প্রয়োজন, জীবন-জীবিকার তাগিদে সমুদ্রে যাইয়া নিখোঁজ হইয়াছে শত শত তাজা প্রাণ। প্রতি বছর সমুদ্রগামী জেলেদের অকালপ্রয়াণে বহু মায়ের কোল খালি হয়, পতিহারা হন অল্পবয়সি বহু পত্নী। কেউ কেউ ভাগ্যক্রমে দুর্ঘটনা হইতে প্রাণে বাঁচিতে পারিলেও সুমদ্রে জেলে সম্প্রদায়ের ক্ষয়ক্ষতির পাল্লা অধিক ভারীই। এই অর্থে সমুদ্রে মত্স্যশিকারি জেলেদের ‘নিরাপত্তা’ দীর্ঘকালের আলোচ্য বিষয়; কিন্তু দুঃখজনকভাবে সমুদ্রে, বিশেষ করিয়া মত্স্যশিকারি জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় নাই আজও। বলিতে হয়, নদী-সমুদ্রে শুধু চোরাচালান ঠেকানো কিংবা জেলেদের গভীর সমুদ্রে যাইতে ‘নিষেধ’ করার মধ্যেই সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তাকর্মীদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ নহে। এবং কেবল আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানাইয়াই দায়মুক্তির কথা চিন্তা করিবার কথা নহে। বরং এই ক্ষেত্রে মানুষকে সচেতন করিবার বিষয়ে আরো জোর দিতে হইবে। বিশেষ করিয়া সমুদ্রে মাছ ধরিতে যেন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করা না হয়, সেই বিষয়ে কঠোর নজরদারির প্রয়োজন রহিয়াছে। এমনকি মাছ ধরিতে যাওয়া জেলের ‘একা হইয়া পড়া’ পরিবারের নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে দৃষ্টিপাতযোগ্য। আলোচ্য ঘটনার পর আমরা খোঁজখবর লইয়া জানিতে পারিয়াছি, সাম্প্রতিক সময়ে মত্স্যশিকারসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের গভীর সমুদ্রে লইয়া যাওয়ার প্রবণতা অধিক বাড়িয়াছে। এই সংবাদ অধিক উদ্বেগজনক। বিষয়টিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমলে লইবেন বলিয়া আমরা আশা করি। সংশ্লিষ্ট মহল এই বিষয়ে কাজ করিতেছেন না—এমনটি বলিতেছি না আমরা। বরং আমরা মনে করি, এই ক্ষেত্রে আরো বিস্তৃত পরিসরে কাজ করা দরকার।
নিরাপত্তাহীনতা আর মৃত্যু যাহাদের নিত্যসঙ্গী, সমুদ্রগামী সেই জেলেদের জীবনমানের উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে বহু প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হইয়াছে—প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নও হইয়াছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে; কিন্তু জেলেদের ‘কৌশল ও নিরাপত্তা’র উন্নয়নে দীর্ঘকাল ধরিয়া বলিয়া আসা ‘আধুনিকায়ন’ আলোর মুখ দেখে নাই এখনো! বলিতে হয়, নদীবিধৌত বাংলাদেশে মত্স্যশিল্পকে অধিক গুরুত্ব দিয়া দেখা উচিত। বিশেষ করিয়া, কূলহীন সমুদ্রবক্ষে মত্স্যশিকারি জেলেদের নিরাপত্তার বিষয়টি অতি জরুরি। নিরাপত্তার ব্যাপারে তাহাদের ব্যাপকভাবে সচেতন করিয়া তুলিতে তো হইবেই, শতভাগ জেলে পরিবারকে কীভাবে ন্যূনতম শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা যায়, সেই বিষয়ে ভাবিতে হইবে ও উদ্যোগ গ্রহণ করিতে হইবে। যতক্ষণ না তাহারা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শিক্ষিত হইতেছে, ততক্ষণ তাহাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করিতে পারাটাই কঠিন বইকি। এই বিষয়ে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ লইয়াছে বলিয়া আমরা শুনিয়াছি; দরকার শুধু ইহার সঠিক বাস্তবায়ন। মনে রাখিতে হইবে, দেশের মত্স্যশিল্প খাতে কয়েক লক্ষ জেলে পরিবার ব্যাপক ভূমিকা রাখিয়া চলিয়াছে। সুতরাং তাহাদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়া দেখিতে হইবে। ভবিষ্যতে মাঝসমুদ্রে জেলের নৌকায় আর কোনো দুধের শিশুকে দেখিতে চাহি না আমরা।