কোন কাগজে যেন পড়েছিলাম বাংলা একাডেমি বইমেলা শুরু হয় ১৯৭২ সাল থেকে। তার আগে বইমেলা বলে কোনো ব্যাপার ছিল না। ভাষাশহিদদের স্মৃতির উদ্দেশে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে নানা রকমের আলোচনা অনুষ্ঠান, কবিতাপাঠ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মঞ্চনাটক ইত্যাদির আয়োজন করত বাংলা একাডেমি। চত্বরটি মাসজুড়ে গমগম করত মানুষের আনাগোনায়। এই দেখে ’৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে একজন প্রকাশক বাংলা একাডেমি চত্বরের খোলা মাঠে চাদর বিছিয়ে বই নিয়ে বসে গিয়েছিলেন। এইভাবে শুরু হয়েছিল বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা।
দু-তিন বছর আগের বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলে বসে আছি, বইমেলার শুরু নিয়ে কথা হচ্ছিল কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে, কে একজন বললেন, ’৭২ সালে যে প্রকাশক খোলামাঠে কাপড় বিছিয়ে বই নিয়ে বসেছিলেন তাঁর প্রকাশনা সংস্থার নাম ‘মুক্তধারা’। তার মানে বইমেলার আইডিয়াটা এসেছিল মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী বাবু চিত্তরঞ্জন সাহার মাথা থেকে।
চিত্তবাবুর সঙ্গে লেখকজীবনের শুরু থেকেই পরিচয় ছিল। আমার প্রথম দুটো উপন্যাসের প্রকাশক তিনি। ‘যাবজ্জীবন’ এবং ‘চিতা রহস্য’। খুবই স্নেহের চোখে দেখতেন আমাকে। এবং এ কথা স্বীকার করতেই হবে স্বাধীনতার পর এ দেশের সৃজনশীল লেখকদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে চিত্তরঞ্জন সাহার ‘মুক্তধারা’ বিশাল ভূমিকা পালন তো করেছেই, প্রকাশনার পথটাও দেখিয়েছে। নতুন-পুরনো কত লেখকের বই যে একটা সময়ে এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়েছে, বলে শেষ করা মুশকিল। কবিতা গল্প উপন্যাস নাটক এবং ছোটদের বইয়ের প্রকাশনায় বিপ্লব ঘটিয়েছিল মুক্তধারা। আর এইভাবে বইমেলা হতে পারে এই ধারণা জন্ম দেওয়ার কারণে মুক্তধারা এবং চিত্তবাবুর কাছে এ দেশের লেখক-প্রকাশক-পাঠকের চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। যদি সেবার এই কাজটা তিনি না করতেন, জানি না আমাদের বইমেলা আজ এই অবস্থায় আসত কি না! কিংবা কতদিন লাগত এই অবস্থায় আসতে। তবে এটাও ঠিক, শুরু তো কেউ না কেউ করেনই।
গত অনেকগুলো বছর ধরে বাংলা একাডেমি বইমেলা আমার সবচাইতে প্রিয় জায়গা। দেশে থাকলে কিংবা শরীর ভালো থাকলে প্রতিদিন বইমেলায় যাই। কোনো না কোনো স্টলে বসি, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হয়, আড্ডা হয়। সারা বছর দেখা হয় না এমন অনেক বন্ধুর সঙ্গে শুধু বইমেলার সময় দেখা হয়। আর পাঠকদের সঙ্গে তো হয়ই। কতজনের কত প্রশ্ন, কত কথা, লেখার ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা। আপনার অমুক বইটি ভালো হয়নি, অমুকটা বেশ ভালো। ঐ বইটা এইভাবে শেষ করেছেন কেন?
অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা বলে, আপনার প্রেমের উপন্যাসগুলো এমন কেন? বেশির ভাগ প্রেমের উপন্যাসেই নায়ক-নায়িকার মিল থাকে না। হাসিমুখে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।
একশ্রেণির পাঠক আছেন তাঁরা এসে অনেক পুরনো লেখার কথা বলেন। ‘পরাধীনতা’র মতো উপন্যাস আর লিখছেন না কেন? ‘ভূমিপুত্র’র মতো লেখা আর কোথায় আপনার?
এই শ্রেণির পাঠকরা গত কয়েক বছর ধরে ‘নূরজাহান’ উপন্যাসটির কথা বলেন। প্রথম পর্ব পড়ে বসে আছেন, দ্বিতীয় পর্বের খবর নেই কেন? গত বছরও এমন অভিযোগ শুনতে হয়েছে দুজনার কাছ থেকে। অথচ ‘নূরজাহান’ দ্বিতীয় পর্ব বাজারে আছে প্রায় তিন বছর ধরে। ভিয়েনা থেকে আসা এক ভদ্রলোক অবশ্য তৃতীয় পর্বের খোঁজ করলেন।
তিরানব্বই সালের কথা। শুধুমাত্র আমার বই নিয়ে কয়েকজন যুবক একটি স্টল করেছে বাংলা একাডেমি বইমেলায়। স্টলের নাম ‘বিনোদন’। বিনোদনের স্টলে সেবার দুটো মজার কাণ্ড ঘটেছিল। আমি স্টলটিতে বসার ফলে বিক্রি কিছুটা বেড়েছিল। ঐ লাইনের দোকানগুলোর মধ্যে বিনোদনেই লোক হতো বেশি। ফলে পাশের দোকানের মালিক-কর্মচারীরা অবজেকশান দিল। আমি ঐ স্টলে বসতে পারব না। এই নিয়ে বেশ ঝগড়াঝাঁটি। পাশের দোকানের মালিক ভদ্রলোক একদিন অভিমান করে তাঁর দোকান বন্ধ করে দিলেন। আমি এত লজ্জা পেলাম! নিজে গিয়ে ভদ্রলোককে রিকোয়েস্ট করে তাঁর দোকান খুলিয়ে অন্যদিকে চলে গেলাম। মেলার শেষদিকে বিনোদনে আর বসা হয়নি।
আর একদিন ঐ স্টলে এসে একটি মেয়ে আমার ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ বইটা কিনেছে। যেহেতু স্টলটিতে শুধুমাত্র আমারই বই, যাঁরাই বই কিনতে আসেন তাঁরাই অটোগ্রাফ নেন। ভেবেছি এই মেয়েটিও নেবে। আমি আগ বাড়িয়ে তার বইটা টেনে নিয়ে মাত্র সই করতে গেছি, মেয়েটি রেগে গেল। আপনি আমার বইতে লিখছেন কেন?
আমি হতভম্ব।
বিনোদন স্টলে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছেন। সেবার আমি ‘ভালোবাসার সুখ দুঃখ’ নামে একটা প্রেমের উপন্যাস লিখেছি। সে বছর বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ কোন সপ্তাহে কোন বই বেস্টসেলার তার একটা তালিকা বের করছে। প্রথম সপ্তাহে আমার বইটা বেস্টসেলার হলো। ফলে বিক্রি বেড়ে গেল। একটা স্টলে বসে সেই বইয়ে অটোগ্রাফ দিই। এত ভিড় হয়েছে, চারজন পুলিশ ভিড় সামলাবার চেষ্টা করছে। আমার কোনোদিকে তাকাবার সময় নেই।
একসময় ভিড় ঠেলে সামনে এলেন ভদ্রমহিলা। বললেন, আমি আপনার বই কিনতে আসিনি। আপনাকে দুয়েকটা কথা বলতে এসেছি। আপনার লেখায় একসময় মাটির গন্ধ পাওয়া যেত। গ্রামজীবন নিয়ে লিখছিলেন। সেসব বাদ দিয়ে এসব কী করছেন? পুলিশ পাহারায় বই বিক্রি হচ্ছে?
ভদ্রমহিলার কথায় সারাটা দিন উদাস হয়ে রইলাম। সে বছরই মার্চ-এপ্রিলে লিখতে শুরু করেছিলাম ‘নূরজাহান’।
বইমেলা এলেই ভদ্রমহিলার কথা মনে পড়ে। আমি যে গ্রামজীবন নিয়ে এখনো লিখি, তিনি কি সেই খবরটা রাখেন? খুব জানতে ইচ্ছে করে।
গত ঈদে ‘প্রথম আলো’র ঈদসংখ্যায় লিখছিলাম, ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’ নামে একটা উপন্যাস। ওটা ছিল একটা বড় উপন্যাসের মাঝখানকার অংশ। প্রথম অংশ ছাপা হয়েছিল সাপ্তাহিক ‘২০০০’-এ। নাম ‘হিজল ফুলের দিন’। শেষ অংশ ছাপা হয়েছিল ‘অন্যদিন’ ঈদসংখ্যায়। নাম ‘ফেলে আসা খড়কুটো’। আত্মজৈবনিক উপন্যাস। আমার জীবনের একটা বিশেষ সময় নিয়ে লেখা। তিন পত্রিকায় আলাদা আলাদা করে লেখা। এবারের বইমেলায় তিনপর্ব একত্র করে বই হয়েছে। ‘প্রথম আলো’র নামটাই রেখেছি, ‘কেমন আছ, সবুজপাতা’। বইটা যেদিন বেরুল, হাতে নিয়ে সেই ভদ্রমহিলার কথা মনে হলো।
বইমেলায় নানা রকমের পাঠক। জনপ্রিয় লেখকদের বই হুড়োহুড়ি করে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো কোনো পাঠক হঠাত্ এসে খোঁজ করেন আড়ালে পড়ে যাওয়া কোনো বইয়ের। সেই বইয়ের নাম শুনলে মন ভালো হয়ে যায়।
বইমেলা এই রকমই।
যতদিন যাচ্ছে বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা ততই দেশের মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করছে, জাতীয় উত্সবে পরিণত হচ্ছে। তারপরও এই মেলা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। একটা সময় ছিল সব দেশের সব ধরনের বই বিক্রি হতো বাংলা একাডেমি মেলায়। সেই সুযোগে ভারতীয় বইয়ের চোরাই সংস্করণে ভরে গিয়েছিল মেলা। সেটা রোধ করার জন্য প্রচলন করা হলো—এই মেলা হবে শুধুমাত্র বাংলাদেশি বইয়ের, বাংলাদেশি লেখক-প্রকাশক-বিক্রেতাদের মেলা। সেই নিয়মটাই চলছে। কিন্তু তখন একটা ব্যাপার ছিল, মেলায় এক প্রকাশক আরেক প্রকাশকের বই ইচ্ছে হলে তাঁর স্টল থেকে বিক্রি করবেন, ইচ্ছে না হলে বিক্রি করবেন না। পাশাপাশি ছিলেন বিক্রেতারা, যাঁরা সব প্রকাশকের বই সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। এবার দেখা যাচ্ছে কঠোর মনোভাব। এক প্রকাশক কিছুতেই অন্য প্রকাশকের বই বিক্রি করতে পারবেন না। আর বিক্রেতা বলে কিছু নেই। এটা শুধুমাত্র প্রকাশকদের মেলা। নিয়মটা আমার ভালো লাগছে না। বইমেলা প্রকাশক বিক্রেতা সবারই মেলা। বই যত সহজে পাঠকের হাতে পৌঁছানো যায় ততই মঙ্গল। সেটাই হওয়া উচিত বইমেলার প্রধান শর্ত। মেলায় ঢুকে একজন পাঠক স্টল খুঁজে খুঁজে তাঁর পছন্দের বইটি কিনবেন কেন? হাতের কাছে পাওয়া যে কোনো দোকান থেকেই তো তিনি সেটা কিনতে পারেন। ব্যবস্থাটি তো এরকমই হওয়া উচিত। এমনিতেই বইয়ের পাঠক কমে যাচ্ছে, তার ওপর এতসব নিয়ম-কানুন করে বইকে দূরে ঠেলে দেওয়ার অর্থ কী?
বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ আকর্ষণ করছি। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ এবং প্রকাশক সমিতির বন্ধুরা, দয়া করে নিয়মটা বদলান। পাঠকের হাতের কাছে এগিয়ে দিন বই। সহজ করে দিন।