সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৯ আশ্বিন ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

সিরিয়া-তুরস্ক ভূমিকম্প

রাজনীতি আগে, না ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য?

আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৫:৫৯

সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের নানাভাবে সহযোগিতা করে তাদের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। তবে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ভোরের আগে প্রথমবার কম্পনের পর খাওলা তার দুই ভাইকে জাগিয়ে তোলে। 

পরিবারটি দক্ষিণ সিরিয়ার ইদলিবে বসবাস করে, ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে যা বেশি দূরে না। ৪৭ বছর বয়সী খাওলা ফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, 'আমরা অনেক ভয় পাই৷ প্রথমে বুঝতে পারিনি কি ঘটছে। আমার দুই ভাই অসুস্থ ছিল। আর বাইরে প্রচণ্ড শীত। এই অবস্থায় আমরা কোথায় যেতে পারি?'

সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের নানাভাবে সহযোগিতা করে তাদের জীবন রক্ষা করা সম্ভব।

তার পরিবার এবং আরও কয়েক প্রতিবেশী পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা ঘরের ভিতরেই থাকবেন। তারা অনেক ভাগ্যবান যে কম্পনে আবার তাদের ভবন কেঁপে উঠলেও তা ভেঙ্গে পড়েনি।

খাওলা বলছিলেন, 'এখানকার অনেক বাড়ি কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ধসে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। অথচ কোন জরুরী বাসস্থানের ব্যবস্থা নাই। কোথাও যাওয়া নিরাপদ না।'  নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি তার পুরো নাম প্রকাশ করতে চাননি। অনেক ঠাণ্ডা সত্ত্বেও অনেকে তাদের ঘরের বাইরে অবস্থান করেছে, অনেকে তাদের গাড়িতেও অবস্থান নেয়।

অনেক ঠাণ্ডা সত্ত্বেও অনেকে তাদের ঘরের বাইরে অবস্থান করেছে, অনেকে তাদের গাড়িতেও অবস্থান নেয়।

তুর্কি সীমান্তের কাছে অবস্থিত ইদলিব সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। অনেক বছরের যুদ্ধে এই এলাকার ভবন ও রাস্তাঘাটগুলো ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত। অথচ ভূমিকম্পের পর পরই সিরিয়ার বাহিনী সেখানে বিদ্রোহীদের অবস্থানে শেল নিক্ষেপ করে। প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র ও উদ্ধারকারীর অভাবের সেখানকার মানুষই আন্তর্জাতিক সাহায্যের উপর নির্ভর করে আছে। 

ফ্রাঙ্কফুর্ট ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা মেডিকো ইন্টারন্যাশনালের হয়ে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ সহায়তায় নিয়োজিত অনিতা স্টারোস্তা জানান, 'বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকা ও এমনকি তার আশেপাশের অঞ্চলে ত্রাণ সামগ্রী নেয়া বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আলেপ্পোর মত জায়গায় সাহায্য পাঠানোও কঠিন। 

তুর্কি সীমান্তের কাছে অবস্থিত ইদলিব সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে।

তিনি ব্যাখ্যা করে জানান, এর মানে হচ্ছে, এসব এলাকায় আসাদ সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সহায়তা সমন্বয় করা যাবে না। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, সরকারের মাধ্যমে যে সমস্ত সাহায্যের অর্থ যায় তা সরকারকে অর্থায়নে সহায়তা করে। কারণ এসব সহায়তা আসাদের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্থাগুলোতে যায়।

ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠে কোভিড-১৯ মহামারির সময়। এটা বড় ধরনের সমস্যা বলে জানান স্টারোস্তা। হামবুর্গ ভিত্তিক জিআইজিএ ইন্সটিটিউট অব মিডল ইস্ট স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো আন্দ্রে ব্যাংক জানান, কোভিডের সময় আসাদ সরকার তার পছন্দের এলাকাগুলোতে ভ্যাকসিন বিতরণ করেছে এবং বিরোধীদের বঞ্চিত করেছিল।

বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকা ও এমনকি তার আশেপাশের অঞ্চলে ত্রাণ সামগ্রী নেয়া বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।

ব্যাংক জানান, সাহায্য সহযোগিতার বেলায় আসাদ সরকার কতটা নির্বাচনমূলক এবং কীভাবে আধিপত্য বজায় রাখতে চায় তার প্রমাণ এটা। ফলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো আসাদ প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে পারে না। ভূমিকম্প আঘাত হানার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সিরিয়ার সরকার কীভাবে এই দুর্যোগকে তার নিজস্ব লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহারের পায়তারা করছে। 

ব্যাংক উল্লেখ করেন, সিরিয়ান আরব রেড ক্রিসেন্ট সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ। ইতোমধ্যে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার দাবি জানিয়েছে এই ত্রাণ সংস্থা, যেন ভূমিকম্পের পর ত্রাণ সহায়তা কাজ সহজ হয়। দেশটির রাজনৈতিক এলিটরা কীভাবে এই দুর্যোগকে কৌশলে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।

ব্যাংক জানান, সাহায্য সহযোগিতার বেলায় আসাদ সরকার কতটা নির্বাচনমূলক এবং কীভাবে আধিপত্য বজায় রাখতে চায় তার প্রমাণ এটা।

বার্লিনে জার্মান-সিরিয়ান এইড অ্যাসোসিয়েশনের (ভিডিএসএইচ) বোর্ডের ডেপুটি চেয়ার সাফোহ লাবানিহও একই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। লাবানিহ বলেন, 'অতীত অভিজ্ঞতা বলছে সিরিয়ার সরকার তার জনগণকে সহায়তা করতে চায় না। সরকার এই ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক বৈধতা ফিরে পেতে চেষ্টা করছে।'

ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত সরকার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে এই ধরণের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। ইদলিব ও বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্যান্য অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ আরও কঠিন। ইদলিবে প্রায় ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে। 

সিরিয়ার সরকার তার জনগণকে সহায়তা করতে চায় না।

এদিকে, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত সহায়তা দিতে তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যকার সব সীমান্ত খুলে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন। গবেষক ব্যাংক এই মতের পক্ষে। 

দীর্ঘ সীমান্তে ২০টিরও বেশি ক্রসিং রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, সিরিয়ার দিক থেকে, এলাকাগুলোর বেশিরভাগই আসাদ সরকারের বিরোধী সিরিয় মিলিশিয়াদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এরা তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। তাই আসাদ সরকার, রাশিয়া বা ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা না করে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মাধ্যমে কাজ করা যায়।

জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত সহায়তা দিতে তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যকার সব সীমান্ত খুলে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন।

এটা করা গেলে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো সেখানে ত্রাণ বিতরণে সক্ষম হবে বলে মতামত ব্যক্ত করেন ব্যাংক। তবে এমনটা সম্ভব হচ্ছে না। আর তাই খাওলা, তার ভাই ও অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ পেতে আরও অপেক্ষা করতে। ইদলিবে অপেক্ষা করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই।

ইত্তেফাক/ডিএস