‘আমি ফিরব না আর, আমি কোনোদিন
কারো প্রেমিক হবো না; প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী চাই আজ
আমি সব প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হবো’ - আবুল হাসান
জীবন আসলে বহতা নদীর মতো। মাঝে মাঝে মর্মন্তুদ দীর্ঘশ্বাস বলে দেয়, যারা গেছে তারা আর ফিরবে না। আজ প্রিয়তমাকে কোনো প্রেমের কাব্য শোনাবো না। আর সবই মৃত্যুর কবিতা শুধু এটাই জীবন। ‘রক্তাত্ত প্রান্তর’-এর ইব্রাহিম কার্দির কথা মনে আছে। মারাঠা শিবির থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে যার কাছে এসেছিল জোহরা। জোহরাকে দেখে কার্দি বলেছিলো, ‘কতোদিন তোমাকে দেখি না। কতোকাল তোমার এ রূপ আমি দেখিনি। অশ্বপৃষ্ঠে নয়, মাটির উপর দাঁড়িয়ে তুমি। রক্তাক্ত তরবারি নয়, হাতে তোমার মেহেদী পাতার রঙ। ওই আনত মুখ, ওই নির্মিলিত চোখ এতো রূপ তোমার। একবার মুখ তুলে তাকাও আমার দিকে।’ এতো ভালোবাসার পরও ফিরে যায়নি কার্দি। জোহরার আহ্বান উপেক্ষা করেই কার্দি বলেছিলো, ‘যে ফিরে যাবে সে আমি হব না। সে হবে ইব্রাহিম কার্দির লাশ। তাকে দিয়ে তুমি কি করবে? তুমি কাঁদছো? ভারতে মুসলিম শক্তি জয়যুক্ত হোক, তার পূর্ণ গর্ব ফিরে পাক। বিশ্বাস করো এ কামনা আমার মনে অহরহ জ্বলছে। কিন্তু আমার সংকটের দিনে যারা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো, কর্মে নিযুক্ত করেছে, ঐশ্বর্য দান করেছে সে মারাঠাদের বিপদের দিনে আমি চুপ করে বসে থাকবো। আমি নিশ্চিত জানি, জয় পরাজয় যাই আসুক মৃত্যু ছাড়া আমার মুক্তির আর কোনো পথ নেই। এ সময় তুমি আমার কাছ থেকে চলে যেও না।’ আসলে বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না দূরেও ঠেলে দেয়। হাহাকার কিংবা কাব্যিক উচ্ছলতা বা হৃদয় কুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসা।
‘তবে মুখানি তুলিয়া চাও,
সুধীরে মুখানি তুলিয়া চাও!
নীরবে একটি চুম্বন দাও,
গোপনে একটি চুম্বন দাও!’
প্রেমের এই গহন গভীর আর্তি তারাই বুঝবে, যারা প্রেমের গহনে ডুবে আছে। এই আবেগের আবেদন চিরন্তন। আলিঙ্গনের পর, প্রেমের গোপন গহন একটি চুম্বন! চুম্বন কি শুধু অধরে ওষ্ঠে মেলামেশা? মোটেই না। সে তো পশু-পাখিরও প্রেম হয়। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘বুক খুলে দাও, দেখি শুভ্র যুগল স্তনের চূড়া নিয়ে নিশিকাব্য লেখি।’
‘বলো যদি স্পর্শ করি, ঠোঁট রাখি দুটি বোটায়।
ফোটাই বনের ফুলকে যেমন
মন্থরা ফোটায়।’
চুম্বন, চুমু, চুম্মা..,কিস্...যে নামেই ডাকা হোক না কেন, চুমুর সেই স্বপ্ন-শিহরণ একটুও যেন কমে না। নানা রূপে নানাভাবে ব্যাপারটা একেবারে রোমান্টিকতায় মাখোমাখো। এ যেন প্রেমিক প্রেমিকার মনের বাগানে ফুটতে থাকা অগণিত গোলাপের আনচান করা সুবাস।
‘তোমার ঠোঁট আমার ঠোঁট ছুঁলো, যদিও প্রথমবার নয়, এবার ঠোঁটে মিলেছে আশ্রয়! অধর মরিতে চায় তোমার অধরে!’ সত্যিই তো! চুমুবিহীন প্রেম যেন অনেকটা লবণহীন তরকারির মতো।
কবিদের কাছে প্রেম আসলে কেমন?
রফিক আজাদ বলেছিলেন, ‘যদি ভালোবাসা পাই, শীতের রাতের শেষে মখমল দিন পাব/ যদি ভালোবাসা পাই, পাহাড় ডিঙাবো, আর সমুদ্র সাঁতরাবো।’
কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরীর মতে, ‘আমার কাছে প্রেম এক অধরা মাধুরী। প্রেম মানে দিগন্তরেখার কাছে সূর্যাস্তের লাল অন্ধকার, না দিন না রাত্রি!’ তাঁর কবিতায়, ‘তুমি কি এখন খুব ভালো আছো সুখী লোকটির পাশে?/ কতটুকু তার মনোযোগ পাও বেদনা বা উচ্ছ্বাসে?/ কী ঈর্ষা করি ওই লোকটাকে/ তবুও ক্ষমা করে দিতে পারি তাকে/ যদি সে তোমাকে আমার চেয়েও বেশি করে ভালোবাসে।’
কবি ও গীতিকার শহীদুল্লাহ ফরায়েজী বলেন, ‘প্রেম আত্মার বসন্ত। ভালোবাসাই মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে, ভালোবাসার কারণেই সমাজ সংসারের বন্ধন রচিত হয়।’
‘তোমার প্রেমে পড়ে কফিন লাগলো গায়ে,
মরার আগে মনটা গেলো মরে,
আমার মতো প্রেমে যেন আর কেউ না পড়ে।’
কবি আমিনুর রহমান সুলতান মনে করেন, ‘স্বর্গীয় প্রেম বলে কোনো প্রেম নেই। আমাদের অনেকে বলে প্রকৃতি প্রেমের কথা। আসলে প্রকৃতির মাঝে একজন নারীকেই খোঁজা হয়। প্রেম প্রথমে নারীকেন্দ্রিক, এরপর প্রকৃতি, স্বদেশ, মা, বোন কেন্দ্রিক।
‘স্পর্শমাত্র চোখ দুটি তোর
শান্ত চোখ, বিদ্ধ করে দ্বগ্ধ করে আমার হৃদয়।
প্রণয়বিহীন যাচ্ছি তবুও সমান্তরাল।’
কবি নাজমুন নেসা পিয়ারি বলেন, ‘প্রেম বিবর্জিত জীবন ভাবা যায় না। প্রেমটা একটা মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো। সেটা প্রেমিকার জন্য হোক বা বাবা-মায়ের জন্য হোক। প্রেম ছাড়া একজন মানুষ নকল মানুষ।’
কবি ওমর কায়সার এর মতে প্রেম হলো, ‘মানুষের আচরণের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপারটি হলো প্রেম। প্রেমে পড়ার পর মানুষ বুঝতে পারে জীবনটা কতো অর্থবহ। আসলে খেয়ে পড়ে মানুষ বাঁচে না, মানুষ বাঁচে প্রেমে। পৃথিবীর সকল প্রাণিই বেঁচে থাকে প্রেমে। নইলে সঙ্গীনির মন জয় করতে বাবুই এত সুন্দর করে বাসা বানায় কেন? কেন এমন আকুল করে ডাকে কোকিল? কেন জোনাকি জৈব প্রভার আলো ছড়িয়ে দেয় রাতে? এই জগত সুন্দর শুধু প্রেমের কারণে।’
‘আমি তো তোমার অন্ধকারের প্রদীপের ভীরু সলতে
আমার জন্ম তোমার জন্য সারাটা জীবন জ্বলতে।’
কবি শিহাব শাহরিয়ার বলেন, ‘কবিদের বিষয় আসলে তিনটি প্রেম প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষ এবং ধর্ম বা আধ্যাত্মবাদ।’ সুতরাং যারা কবিতা লেখে তারা প্রথম বয়সে প্রেমের কবিতা দিয়ে শুরু হয়। কলেজ জীবনের যখন টাটকা বয়স তখন একটি ছেলে একটি মেয়ের চোখ দেখে যে সৌন্দর্য্য আবিষ্কারের চেষ্টা করে সেখান থেকেই কবিতার শুরু। আমিও কলেজের প্রথম বর্ষেই কবিতার দিকে যাই। আমার প্রথম কবিতার চারটি লাইন এখনো মনে আছে-
‘এই শহরে আমি এখন সুখেই থাকি,
তোমার স্মৃতি মনের ভেতর লুকিয়ে রাখি।
বাইরে যখন গোলাপ ফুলে বৃষ্টি ঝড়ে,
তুমি তখন একলা থাকো ওই নগরে।’
এই যে প্রেমের একটি বহিঃপ্রকাশ। এই প্রকাশ থেকে কবিতার সৃষ্টি। কবিদের প্রেমে পড়ার আরেকটি কারণ আছে। কবিতা হচ্ছে সাহিত্যের সবচেয়ে উঁচু মাধ্যম। ক্লাসিক মাধ্যম। কাজেই কবি যখন তাঁর প্রেমিকাকে কল্পনা করেন সেটি শুধুমাত্র একটি কবিতার মাধ্যমে শেষ করা যায় না। সারাজীবন অনুরণন করেন। সুতরাং প্রেম প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে। কেউ প্রকাশ করতে পারেন কেউ করেন না।
কবি ইউসুফ মুহম্মদ মনে করেন, ‘প্রেম শুধু একটি শব্দ নয়, এর অন্তর্গত ভাব, অনুবৃত্তি বিস্তার ও ব্যাপক। প্রেম বলতে দুজন মানব-মানবীর নিছক মন দেওয়া-নেওয়া নয়। দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেলে তা দেশপ্রেম। কেউ যদি মনুষ্য সমাজের প্রতি অনুরক্ত হয় সেটা মানব প্রেম। এভাবে ভাই-বোন, মা-বাবার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ পেলে তাও প্রেম। প্রকৃতির প্রতি হৃদয় বিগলিত হলে তা প্রকৃতি প্রেম। মহাশক্তির প্রতি আসক্ত হলে আমরা বলি ঈশ্বর প্রেম। এতে বুঝা যায়, প্রেমের রয়েছে বিচিত্র রূপ। এর ব্যাপ্তিও সুদূরপ্রসারী। প্রেম নিত্য, প্রেম সত্য, প্রেম আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর।’
কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া বলেন, ‘তুমি আমার অরণ্যগান অক্সিজেন/তুমি আমার বুকের জিকির, গভীর ধ্যান।’
কবি সৌমিত্র দেব বলেন, ‘প্রেম আর ভালোবাসা শব্দ দুটি পাশাপাশি নিজস্ব এক নদী। ভীড়ের ভেতর একাকি হারিয়ে যাওয়া। ভালোবেসে আমি হয়েছি অন্ধ বধির, ভুলে গেছি ঘুম, ভুলে গেছি নাওয়া খাওয়া।’
কারও কাছে প্রেমের গভীর অনুভূতি ঠিক যেন প্রার্থনার মতো। কবি শরাফত হোসেন বলেন, ‘প্রেম আমার কাছে প্রার্থনা। যে প্রার্থনা অনুভূতির গভীরতম প্রকাশ। নিজেকে উজাড় করে সন্তুষ্টি অর্জনের প্রাণান্ত চেষ্টা। বলা ভালো প্রশান্তি লাভের মাধ্যম। ব্যক্তির পরিপূর্ণ প্রকাশ বা সন্তুষ্টি ভালোবাসার মধ্যে খুঁজে পাওয়া সহজ। এটা এমন এক টান, যে টান মানে না ভৌগোলিক সীমানা। ধর্ম, বর্ণ, জাত তুচ্ছ করে মিলন বা বিরহ যাপনের নামই ভালোবাসা।’ তিনি তার কবিতায় প্রেমকে দেখেছেন এভাবে-
‘জল গড়িয়ে ধৌলগিরি মিলিত হবে তিতাসের সঙ্গে
আমি হিড়িম্বা মন্দিরে প্রার্থনায় বসি, তুমি লুম্বিনি
বস্তুত আমরা প্রার্থনায় একে অপরকে খুঁজি, নিজেকে হারিয়ে।’