শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

প্রতিটি মানুষই প্রেমকাতর, মনে করেন কবি শরাফত হোসেন

আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৯:২৩

      ‘জল গড়িয়ে ধৌলগিরি মিলিত হবে তিতাসের সাথে
       আমি হিড়িম্বা মন্দিরে প্রার্থনায় বসি, তুমি লুম্বিনি
       বস্তুত আমরা প্রার্থনায় একে অপরকে খুঁজি-
       নিজেকে হারিয়ে!’

কবি শরাফত হোসেন সেটুকুই লেখেন, যেটুকু ভাবেন কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন না মুখে। কবিতা তার কাছে প্রার্থনা, অনুভূতির গভীরতম প্রকাশ। মানবতা যেখানে গৌণ—স্বার্থের কাছে; সেখানে কবিতা মহৎ এক শিল্পমাধ্যম-আত্মার শুদ্ধি, বোধের জাগরণ। সেই বোধের কবির কাছে জানতে চাই প্রথম লেখার কথা?

‘আমার বাবা কবিতা লিখেন। সাহিত্য একাডেমির সভাপতি, সে সূত্রে সংগঠনে আসা-যাওয়া, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি টান তৈরি হয়। টেবিলে রেখে যাওয়া বাবার কবিতা পড়তাম। বাসায় অনেক কবিতার বই ছিল, ছিল কবিদের আসা যাওয়া। কবিতা পড়ে, কবিদের সান্নিধ্যে এসে কবিতার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মে। একদিন বিকালে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় একটা পুকুরে স্বচ্ছ পানির মধ্যে কিছু মাছ খেলা করছে। ওই দৃশ্য আমার মনে আলোড়ন তোলে। মাথার মধ্যে একটি লাইন তৈরি হয়। এভাবেই কবিতা চর্চার শুরু।’

প্রথম কবিতা কোনটি লিখলেন?

‘প্রথম কবিতার কথা ওভাবে মনে নেই। তবে প্রথম ছাপা কবিতা ছিল ‘জলজদহন’। আজকের কাগজের সাহিত্যপাতা সুবর্ণরেখায় ছাপা হয় কবিতাটি। কয়েকটি লাইন ছিল এমন ‘আঙরার তাপে যেটুকু তপ্ত হয় গতর/তারও বেশি তাপ ভালোবাসায়।/গাঙের পানিতে আঙরা নিভে/চোখের জলে ভালোবাসা ক্রমশ/ জ্বলে জ্বলে উঠে/ঘাসফুল তোমার সাথে।’

 

‘নির্বাচিত উনপঞ্চাশ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন কবি মুহাম্মদ সামাদ

কতো বছর ধরে লিখছেন?

‘লেখালেখি বছর হিসাব করলে ১৮/২০ বছর হবে। এসএসসি পরীক্ষার সময় থেকেই লেখালেখি শুরু করি। আর প্রথম বই প্রকাশ হয় ২০১১ সালে। কবিতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছি এক যুগ হবে।’

আপনার বইয়ের সংখ্যা?

‘এই পর্যন্ত চারটি কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে একটি কলকাতার কবি বল্লরী সেনের সঙ্গে যৌথ কবিতাগ্রন্থ ‘কাফনলিপি’। গ্রন্থটি প্রকাশ করে কলকাতার প্রকাশনা সংস্থা খসড়াখাতা, ২০২০ সালে । অন্য বইগুলো হলো ‘ঘাসফুল তোমার সাথে’ (২০১১), ‘ফিরে আসি কাচের শহরে’ (২০১৫)। এবার চতুর্থ বই ‘নির্বাচিত উনপঞ্চাশ’ প্রকাশ করেছে শ্রাবণ প্রকাশনী।’

কবিতায় আসলে কোন বিষয়গুলো আনতে চান? আপনার কবিতা মানুষ কেন পড়বে?

‘মানুষের জীবন-যাপন, সুখ-দুঃখের অনুভূতি, দেশপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম সবই কবিতায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। ব্যক্তিপ্রেম কখনো আমাকে আবেগাক্রান্ত করেছে, কখনো দেশপ্রেম। আমার ভেতরের যে অনুভূমি সেটাকে আমি সর্বজনীন করে তোলার চেষ্টা করেছি লেখার মধ্য দিয়ে। আমার বিশ্বাস, এজন্যেই আমার কবিতা পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। অনেক পাঠকের সাড়া যেমন পেয়েছি, তেমনি অনেক সাহিত্য-সমালোচক আমার কবিতা নিয়ে বলেছেন, লিখেছেন।

আপনার কবিতা কি মূলত প্রেমকেন্দ্রিক?

‘সেটা সরাসরি বলাটা একটু দুরূহ। আমি মনে করি, মানুষ মাত্রই প্রেমকাতর। প্রেম ছাড়া কিছুই নেই। মানুষের জীবনে যে সুখানুভূতি ও দুঃখবোধ; সেটাও আসলে একরকম প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ। এদিক থেকে যদি বলি প্রেমকেন্দ্রিক, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু আমার লেখায় জীবন-যাপন, বেড়ে ওঠা, চারপাশের জগৎ- এসব কিছুই প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। বলতে পারেন আমার দেখার জগৎ, জানার জগৎ এবং এর মধ্য দিয়ে অর্জিত জ্ঞানই আমার লেখার উপজীব্য।’

আপনার লেখা ভালোলাগা কয়েকটি কবিতার কথা যদি বলেন?

‘নিজের সব সৃষ্টিই আমার ভালো লাগে, আলাদা করে বলা কঠিন। আলাদা করে বলতে গেলে  'দুটো ফুল দুটো দেশ', 'অখণ্ড', 'সীমানা', 'সান্ত্বনা', 'বেহুলার প্রতি', 'রোদের শরীর', 'ইনসুজো', 'রক্তফোটা বাংলাদেশ' কবিতাগুলোর কথা প্রথমেই মনে আসে। প্রিয় কবিতার লাইন যদি বলি, 'সীমানা' কবিতা থেকে- ‘আকাশে গুচ্ছ মেঘের দল আনমনে পেরিয়ে যায় সীমারেখা/নিজের অজান্তেই শালিক পাখিটি ওপার ঘুরে আসে।/তোমাদের সীমানাপ্রাচীর হয়ে বৃষ্টির জল/নেমে আসে এ তল্লাটে-অনায়াসে/ঝড়ো হাওয়ার সাথে শুকনো পাতার দল।’ এ কবিতার শেষের স্তবক 'আলিঙ্গনের দূরত্ব রাইফেলের নল/এপারে আসতে মানা, ওপারে যেতে/অন্ধকার ঘিরে থাকে কাঁটাতার জুড়ে।’

আমি মনে করি, মানুষের মধ্যে কোনো ভৌগলিক সীমারেখা থাকা উচিত নয়। অথচ আমরা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সীমান্ত তৈরি করেছি। মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি করেছি। যখন মানুষের মনকে সীমারেখায় বাঁধতে পারি না, তাহলে কেন  শরীরকে আটকে রাখা? এই বিষয়গুলো আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়।

কোনো কবির কবিতা কি আপনার লেখায় প্রভাব ফেলে?

‘লেখায় প্রভাব ফেলে বলে মনে করি না। কিন্তু ভাবনায় ফেলে। শুরুতেই বলেছিলাম, আমার বাবার কবিতা পড়েই কিন্তু লেখার শুরু। ছেলেবেলায় শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, আল মাহমুদ, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, মুহাম্মদ সামাদের মতো কবিদের আনাগোনা ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তাদের সান্নিধ্য পেয়ে এবং কবিতা পড়ে আমার বড় হওয়া। বড় হতে হতে সত্তর-অশি-নব্বই দশকের কবিদের কবিতা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাদের চিন্তা ব্যক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে, কিন্তু লেখায় তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে চেষ্টা করেছি।’

কথিত আছে কবিরা প্রেমকাতর বা বিরহী হলেই ভালো কবিতার জন্ম হয়, আপনার মত কী?

‘প্রতিটি মানুষই আসলে প্রেমকাতর। দুঃখবোধ প্রতিটি মানুষকে নিশ্চয়ই নতুন করে ভাবায়। মানুষ যখন দুঃখ পায়, তা যদি খুব প্রিয় মানুষের কাছ থেকে পেয়ে থাকে, তখন সে ব্যথা তাকে বেশির দগ্ধ করে। সচরাচর আমরা যে আচরণ সহজভাবে গ্রহণ করি, ব্যথা পেলে একই আচরণকে ভিন্নভাবে ব্যাখা করি। এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। তাই বলি প্রেম, দুঃখবোধ এগুলো সাধারণ মানুষকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি কবিকেও করে। কবিরা লেখায় প্রকাশ করেন বলে আরও গভীরভাবে ভাবেন। ভাবনার জগৎ যত গভীর, লেখাও ততই  ঋদ্ধ হয়। 

কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে বলে একটা কথা শোনা যায়, আসলে কি তাই?

‘পাঠক কমে যাচ্ছে এটা আমি মনে করি না। এক সময় যেমন মানুষের মুখে মুখে কবিতা ফেরি হতো, সেই জায়গাটিতে কিছুটা ঘাটতি দেখছি। সেরকম কবিতা হয়তো লিখতে পারছি না আমরা। কিন্তু পাঠক আছে। পাঠক না থাকলে নিশ্চয়ই এত বই বিক্রি হতো না। এখন নানান কারণে গল্প, উপন্যাস, কবিতার আড্ডা সীমিত হয়ে আসছে। বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে গিয়ে আমরা শেকড়চ্যূত হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। সেটা একটা কারণ হতে পারে। দ্বিতীয়ত মুখে মুখে ফেরার মতো কবিতা পাচ্ছি না।’

কবি শরাফত হোসেনের জন্ম ১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাবা জয়দুল হোসেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, কবি ও সংগঠক: মা হাসনেয়ারা বেগম সরকারি চাকরিজীবী। স্কুলজীবন থেকেই তিনি নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। লেখালেখির শুরু ওই সময়েই। কবি হিসেবে দুই বাংলায় তিনি সমানভাবে পরিচিত। একাধিক জাতীয় দৈনিকের বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে ‘সাহিত্য একাডেমি পত্রিকা’র নির্বাহী সম্পাদক। সম্পাদনা করছেন ছোটকাগজ ‘বুক রিভিউ’।

বর্তমানে কাজ করছেন দৈনিক ইত্তেফাক ডিজিটাল বিভাগের প্রধান হিসেবে। পড়াশোনা ব্যবসায় প্রশাসনে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

এছাড়া জাতীয় কবিতা পরিষদ, সাহিত্য একাডেমি, পেন বাংলাদেশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সমিতি এবং সদর উপজেলা সমিতিসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন।

ইত্তেফাক/পিও