শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৭ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

নূতন যুগে আর্জেন্টিনা-বাংলাদেশ সম্পর্ক

আপডেট : ০১ মার্চ ২০২৩, ০০:১৬

আধুনিক কূটনৈতিক ব্যবস্থায় পিপল টু পিপল বা পাবলিক ডিপ্লোমেসির গুরুত্ব সর্বাধিক। বিশেষ করিয়া দুই দেশের চিন্তাচেতনা, ঐতিহ্য বা সংস্কৃতিগত মেলবন্ধন টেকসই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের রক্ষাকবচ। এক দেশের মানুষ যখন যে কোনো উপলক্ষ্যে অন্য দেশের মানুষকে প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করে, তখন সেই ভালোবাসার মূল্যকে উপেক্ষা করিতে পারে না কোনো দেশই। সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনা। এই দেশটি ফুটবল বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ আর্জেন্টিনার নৈপুণ্যময় ফুটবলের ভক্ত। গেল ফুটবল বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে লইয়া এই দেশের মানুষের মাতামাতির শেষ ছিল না। বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার ফুটবল টিমের অধিনায়ক ও তারকা ফুটবলার মেসির আগমনের প্রতীক্ষায় রহিয়াছে বাংলাদেশ। সেই ফুটবলপ্রীতি, মৈত্রী ও কূটনীতির সূত্র ধরিয়া অবশেষে আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের সহিত নব উদ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের উদ্যোগ লইয়াছে। ৪৫ বৎসর পর ঢাকার বনানীতে উদ্বোধন করা হইল আর্জেন্টিনার দূতাবাস। 

আর্জেন্টিনার পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমন্ত্রী সান্তিয়াগো আন্দ্রেস ক্যাফিয়েরো দুই দিনের ঢাকা সফরে আসিয়া বাংলাদেশের মানুষকে জয় করিয়া লইলেন। তিনি লাভ করিলেন অফুরন্ত ভালোবাসা ও উষ্ণ অভ্যর্থনা। বাংলাদেশ সফরে তিনি আর্জেন্টিনার দূতাবাস উদ্বোধনের পাশাপাশি বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনা ভিসা অব্যাহতি চুক্তি, দুই দেশের ফুটবল সহযোগিতা এবং কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতামূলক সমঝোতা স্মারকে সই করেন। গতকাল তিনি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহিত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী দেশের ফুটবল খেলার উন্নয়নে বর্তমান বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার সহযোগিতা কামনা করেন। এই সময় তিনি বলেন, ‘মেসির নাম এবং আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলা বাংলাদেশের ঘরে ঘরে খুবই জনপ্রিয়’। এই বৈঠকে বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার মধ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াইবার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আর্জেন্টিনা বাংলাদেশ হইতে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি উচ্চমানের ফার্মাসিউটিক্যাল, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি করিতে পারে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ আর্জেন্টিনা হইতে গম, চিনি, সয়াবিন, অ্যানিমেল ভেজিটেবল ফ্যাটস অ্যান্ড ওয়েল, তৈলবিজ, ফলমূল, দুগ্ধজাত পণ্য এবং প্রাকৃতিক মধু আমদানি করিতে পারে। আর্জেন্টিনা বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলেও বিনিয়োগ করিতে পারে। এইভাবে শুধু ফুটবলের উন্নয়নই নহে, আমরা ব্যবসায়-বাণিজ্যের দিক হইতেও প্রভূত উপকৃত হইতে পারি। ইহা ছাড়া আরো নানা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার দ্বার উন্মোচন করিতে পারি আমরা।

উল্লেখ্য, আর্জেন্টিনা ১৯৭৪ সালে ঢাকায় প্রথম তাহার দূতাবাস খোলে; কিন্তু ১৯৭৮ সালে তাহা বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। ইহার পর নয়াদিল্লি হইতে দূতাবাসের কার্যক্রম পরিচালিত হইত। এখন ঢাকার বনানীতে আবার দূতাবাস খোলায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের নূতন বাতাবরণের সুযোগ তৈরি হইয়াছে। ইহা ছাড়া আর্জেন্টিনার কবি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সহিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক, একাত্তরে স্বাধীন দেশের প্রতি স্বীকৃতি আমাদের সম্পর্ককে পূর্ব হইতেই জীবন্ত রাখিয়াছিল। তবে সবচাইতে বড় বিষয় হইল, আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের আকাশি-সাদা জার্সির প্রতি এই দেশের মানুষের গভীর টান, ইহার মূল্যই অধিক। ফুটবলে এই দেশটির জয়লাভে আমরা আনন্দিত হই আবার পরাজয়ে হই ব্যথিত। এমনকি আর্জেন্টিনার পরাজয়ে আমাদের দেশে একশ্রেণির ফুটবলভক্তের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটিয়াছে। এই ফুটবল মৈত্রীই আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের প্রাণস্বরূপ। ইহার কারণে বিশ্বকাপ শেষ হইবার মাত্র তিন মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দূতাবাস খোলা সম্ভব হইল। মানুষ কীভাবে তাহার দেশের সরকারকে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তৈরিতে উত্সাহিত করিতে পারে, এই ঘটনা তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আমরা বাংলাদেশে আর্জেন্টিনার মিশন চালুর উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আশা করি, ইহাতে দুই দেশের সম্পর্ক এখন আরো গতিশীল ও হৃদ্যতাপূর্ণ হইবে। এই জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাই অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন