নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের সহিত সম্পৃক্ত। এক মাস পূর্বে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে একটি টোল ফ্রি হটলাইন চালু করিয়াছে। ১৬১৫৫ হটলাইন নম্বরে ফোন করিয়া খাদ্য-সম্পর্কিত যে কোনো পরামর্শ বা অভিযোগ জানানো যাইতেছে। এই টোল ফ্রি নম্বরে কেহ অভিযোগ করিলে অভিযোগসমূহের বিষয়ে ব্যবস্থা লইতে সংশ্লিষ্ট জেলা নিরাপদ খাদ্য কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছে। ইহা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
আয়তনে বাংলাদেশ বিশ্বের ৯৪তম দেশ হইলেও জনসংখ্যায় অষ্টম। এই দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৬৫ জন মানুষ বসবাস করেন। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার ভিতর দিয়াই গত ৫২ বৎসরে উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের গড় আয়ুও তাৎপর্যপূর্ণ মাত্রায় বৃদ্ধি পাইয়াছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টিকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা রহিয়াছে। ইহার জন্য দক্ষ মানবসম্পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এই মানবসম্পদ গড়িতে প্রয়োজন সুস্থ দেহ। এই ক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য সুরক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে শুধু বাংলাদেশে নহে, বিশ্ব জুড়িয়াই খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য লইয়া দুশ্চিন্তা তৈরি হইয়াছে। বলিবার অপেক্ষা রাখে না, নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি পুষ্টি-নিরাপত্তার সহিত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যনিরাপত্তা-সংক্রান্ত সরকারি নজরদারি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও নিয়মতান্ত্রিক বলিয়া বিবেচনা করা হয়। ইহা কিন্তু রাতারাতি হয় নাই। ১৯০৫ সালে আপ্টন সিনক্লেয়ার নামের একজন লেখক প্রকাশ করেন ‘দ্য জাঙ্গাল’ নামের একটি গ্রন্থ। প্রকাশিত বইটি লেখা হইয়াছিল অভিবাসীদের লইয়া, যাহারা শিল্পাঞ্চলে বসবাস করিত। বইটির লেখক ছদ্মবেশ লইয়া শিকাগোর একটি মাংসের খামারে কর্মচারী হিসাবে কাজ করিয়া দেখিয়াছিলেন সেইখানে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও বিপণন করা হইতেছে। এই অভিজ্ঞতা হইতেই তিনি লেখেন ‘দ্য জাঙ্গাল’ বইটি। বইটি একসময় নজরে আসে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের। ইহার পরই রুজভেল্ট উদ্যোগ গ্রহণ করিয়া ‘পিওর ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাক্ট’ এবং ‘ফেডারেল মিট ইন্সপেকশন অ্যাক্ট’ পাশ করান। ইহার পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপদ খাদ্যের জন্য আলাদা কোনো আইন ছিল না। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে যুক্ত হইয়াছে আরো নানান আইন। সর্বশেষ ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জমানায় নিরাপদ খাদ্যের জন্য আরেকটি আইন পাশ হয় ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড মডার্নাইজেশন অ্যাক্ট’ নামে। এই আইনসমূহের সঠিক প্রয়োগের কারণেই সেই দেশটিতে খাদ্য তুলনামূলক নিরাপদ।
আমাদের দেশেও ‘নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩’ রহিয়াছে। তবে আইন থাকিলেই কিংবা নূতন হটলাইন চালু করিলেই আমাদের খাদ্য নিরাপদ হইয়া যাইবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমাদের দেশে কেবল রাজধানী ঢাকাতেই প্রতিদিন অর্ধকোটি মানুষ রাস্তার খাবার খাইয়া থাকেন। অথচ ইতিপূর্বে পরিচালিত জরিপে দেখা গিয়াছে, ঢাকার প্রায় ৯০ শতাংশ রাস্তার খাবারে ক্ষতিকর জীবাণুর উপস্থিতি রহিয়াছে। বিশ্বের অনেক দেশেই রাস্তার খাবার তৈরি ও পরিবেশন করা হয় স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে; কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ রাস্তার খাবার প্রস্তুত ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এই সকল বিষয়ের কোনো বালাই নাই। দূষিত পানি, ধুলাবালি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ অধিকাংশ রাস্তার খাবারকে করিয়া তুলিয়াছে অনিরাপদ। ফলে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিদিন এই সকল খাবার খাইতেছেন, তাহারা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন।
মনে রাখিতে হইবে, একটি খাদ্য তখনই নিরাপদ হইবে যখন উহার উৎপাদন প্রক্রিয়া হইতে শুরু করিয়া বিপণন, রান্না, পরিবেশন এবং খাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পদে উহা নিরাপদ থাকিবে। স্পষ্টতই, অসাধু বা অসচেতন উৎপাদক বা ব্যবসায়ীদের কারসাজি ছাড়াও নানা কারণে খাদ্য দূষিত বা অনিরাপদ হইতে পারে। অন্যদিকে, রাস্তার খাবার অনিরাপদ হওয়ার উল্লেখযোগ্য বড় কারণ ক্রেতাদের অসচেতনতাও। চোখের সম্মুখে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে খাবার তৈরি হইতেছে দেখিয়াও নির্বিকারচিত্তে অনেক শিক্ষিত মানুষ এই ধরনের খাবার গ্রহণ করিয়া থাকেন। সরকার হটলাইন চালু করিয়াছে বটে; কিন্তু আমরা কি নিজেদের একবার প্রশ্ন করিয়াছি—এই ব্যাপারে আমরা কতখানি সচেতন? নিজেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি না হইলে কোনো হটলাইনই কাজে আসিবে না।