শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৭ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

সচেতন না হইলে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যাইবে না

আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৩, ০৪:১৯

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান লইয়া বিতর্ক নূতন নহে। সেইখানে নির্বাচন মানেই জালিয়াতি, ভোটচুরি, মারামারি, হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ ইত্যাদি। এই সকল দেশে নির্বাচনি ফল না মানিয়া লইবার সংস্কৃতি যেমন বিরাজমান, তেমনি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার পালাবদল না হওয়ায় অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা লাগিয়াই আছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়াতে অনুষ্ঠিত হইয়া গেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তিন জন প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বোলা আহমেদ তিনুবুকে নির্বাচন কমিশন বিজয়ী ঘোষণা করিয়াছে। কিন্তু দেশটির প্রধান বিরোধী দল সেই ফল মানিয়া লইতে নারাজ। ইহার সমর্থকরা এখন রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতেছে। অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকার সবচাইতে বৃহত্তম দেশ ব্রাজিলে গত বৎসর অক্টোবরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বামপন্থি লুলা ডি সিলভা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মধ্য দিয়া বিজয় লাভ করেন। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো-সমর্থকরা তাহা মানিয়া নিতে অস্বীকৃতি জানাইয়া রাজপথে নামিয়া আসে। এইভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে শুধু নির্বাচনের আগেই নহে, নির্বাচনোত্তর সহিংসতাও একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হইয়াছে। এই সকল দেশে নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হওয়াটা যেন সুদূর পরাহত। তবে ভোট যথাসময়ে ও যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত না হইবার প্রধান কারণ ভোটারদের অসচেতনতা। ভোট প্রদান করা নাগরিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার ও পবিত্র দায়িত্ব। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি মানুষের মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি একটি গণতান্ত্রিক দেশে মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের চোখে সমান অধিকার, ভোটের অধিকার ইত্যাদিও বিশ্বস্বীকৃত। বিশ্বস্বীকৃত এই অধিকার নিশ্চিত করিতে হইলে নির্বাচনে ভোটারদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা দরকার। কোনো কারণে তাহার এই অধিকার লঙ্ঘিত হইলে সংঘবদ্ধভাবে তাহার প্রতিবাদ করিতে হয়। অর্থাৎ ভোটাররা দায়িত্বশীল না হইলে কোনো দেশে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা দুরূহই বটে।

এখন প্রশ্ন হইল, সচেতনতা কীভাবে আসিবে? সচেতনতার বড় উৎস হইল শিক্ষা। মানুষ সুশিক্ষিত হইলে তাহাকে তাহার অধিকার হইতে বঞ্চিত করা কঠিন। তবে শুধু সচেতন হইলেই চলিবে না, মানুষকে আর্থিকভাবেও স্বাবলম্বিতা ও সক্ষমতা অর্জন করিতে হইবে। শিক্ষিত ও অর্থবান ব্যক্তির অধিকার কাড়িয়া লইবার দুঃসাহস কেহ দেখাইতে পারে না। তৃতীয়ত নির্বাচনি ব্যবস্থা, আইনকানুন ও নীতিমালা যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত হওয়া প্রয়োজন। গতকাল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি খবর প্রকাশিত হইয়াছে যে, আমাদের নিকট-প্রতিবেশী ও বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সুপ্রিম কোর্ট এক তাৎপর্যপূর্ণ রায় দিয়াছে। এই রায়ে বলা হইয়াছে যে, এখন হইতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও দুই নির্বাচন কমিশনার নিযুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও লোকসভার বিরোধী দলের নেতাও অংশগ্রহণ করিবেন। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের প্রধান যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হন, নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্যও একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্ত হইবেন। দেশটিতে এমনিতেই যুগ যুগ ধরিয়া নিরবচ্ছিন্নভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়া আসিতেছে। তাহার পরও আরও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এমন রায় দেওয়া হইয়াছে, যাহা উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য অনুসরণীয়। কোনো কোনো উন্নয়নশীল দেশে দেখা যায়, নির্বাচন করিবার ক্ষমতা বহুলাংশে নির্বাচন কমিশনের হাতেই নাই। ইহা শেষ পর্যন্ত চলিয়া যায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিকট। সেইখানে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা কিংবা স্বয়ংসম্পূর্ণ বা নির্ভরযোগ্য জনবলকাঠামো নাই বলিয়া সাংবিধানিক দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করিতে পারে না তাহারা। এই সকল ফাঁকফোকর বন্ধ না করা পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নহে।

একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের সকল প্রকার অধিকার নিশ্চিত করিতে হইলে সর্বাগ্রে যে কোনো উন্নয়নের চাইতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে হইবে। একই সঙ্গে ভোটের গুরুত্ব অনুধাবন করিতে হইবে ভোটারদেরই। তাহারা অতন্দ্র প্রহরীর মতো সতর্ক থাকিলে ভোট লইয়া কোনো প্রকার অনিয়ম ও জালিয়াতির সুযোগ থাকিবে না। অতএব, শুধু গতানুগতিক ভোটার দিবস পালন করিলেই চলিবে না, ভোটাররা ভোট রক্ষা করিবার অঙ্গীকার করিতেছে কি না তাহাও দেখা প্রয়োজন।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন