ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যে তিনটি রাজ্যে আজ বিধানসভার ভোট গণনা হয়েছে, তার সবগুলোতেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি ভোটের আগে বা পরে করা জোটের সঙ্গীদের নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চলেছে। এই রাজ্যগুলো হলো ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও মেঘালয়।
৬০ আসনের ত্রিপুরা বিধানসভায় বিজেপি ও তাদের জোটসঙ্গী আইপিএফটি ৩৩টি আসন পেয়ে গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে, যদিও তা গতবারের ৪৪ আসনের চেয়ে অনেকটাই কম। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সদস্য প্রদ্যোত দেববর্মার নতুন দল তিপ্রা মোথা পেয়েছে ১৩টি আসন, আর বামপন্থী ও কংগ্রেসদের জোট মোট ১৪টি আসনে জিতেছে।
নাগাল্যান্ডে বিজেপি ১২টি ও তাদের পুরনো শরিক দল এনডিপিপি ২৫টি আসন পেয়েছে, ফলে ৬০ আসনের বিধানসভায় তারা সরকার গড়ছে অনায়াসেই। এনডিপিপি নেতা নেইফিউ রিও পঞ্চমবারের মতো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন।
মেঘালয়ে ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) সঙ্গে বিজেপির জোট ভেঙে গিয়েছিল ভোটের আগেই, কিন্তু ভোটে একক গরিষ্ঠতা না পাওয়ার পর এনপিপি নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে ফোন করেন। বিজেপি ও অন্য কিছু ছোট দলের সমর্থন নিয়ে কনরাড সাংমাই যে আবার মেঘালয়ে সরকার গড়বেন, সেটাও তখনই চূড়ান্ত হয়ে যায়।
ভারতে এই ২০২৩ সালজুড়ে মোট দশটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হবে, এরপর আগামী বছরের প্রথমার্ধেই হবে দেশব্যাপী লোকসভা নির্বাচন। বলা যেতে পারে, চলতি বছরে দেশে ভোটের মরশুম শুরুই হলো এই তিনটি রাজ্য দিয়ে, আর তার ফলাফল অবশ্যই বিজেপির মনোবল বাড়াবে।
অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এই তিনটি রাজ্যেই খুবই খারাপ ফল করেছে। দিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক আমন শর্মার মতে, আজকের তিনটির রাজ্যের ফলাফলের মধ্যে ত্রিপুরার ফলাফল বিজেপির কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, 'তারা প্রমাণ করতে পেরেছে ২০১৮ তে বামপন্থীদের হারিয়ে তাদের ত্রিপুরায় জেতাটা কোনো ফ্লুক ছিল না!'
শর্মা বিবিসিকে আরও জানিয়েছিলেন, অতীতে বিভিন্ন রাজ্যে বহু বারই দেখা গেছে যখনই রাজ্যে বিরোধী শক্তিগুলো জোট বেঁধে বিজেপির মোকাবিলা করেছে তখনই বিজেপি বেশ বেকায়দায় পড়েছে। ২০১৫ সালের বিহারের নির্বাচন ছিল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
তিনি বলছিলেন, 'ত্রিপুরাতেও এবার বিরোধী বামপন্থী ও কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়েছিল, পাশাপাশি ছিল উপজাতীয়দের নতুন দল তিপ্রা মোথা। এই ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই সে রাজ্যে বিজেপির জেতা সম্ভব হয়েছে, গতবারের তুলনায় আসন কম পেলেও তারা রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে।'
ভারতে যে সব রাজ্যে নির্বাচন আসন্ন, সেখানে বিজেপি-বিরোধী শক্তিগুলো যদি জোট বেঁধে লড়তে পারে তাহলে তারা বিজেপিকে বেগ দিতে পারবে। ত্রিপুরার ফলাফল সেটাই আরও একবার প্রমাণ করে দিল বলে পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করছেন।
সামনে এপ্রিল-মে মাসেই ভারতের আর একটি বড় রাজ্য কর্ণাটকে নির্বাচন, সেখানেও বিরোধী কংগ্রেস ও জনতা দল (সেকুলার) যাতে জোট বেঁধে ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে পারে উভয় দলের পক্ষ থেকেই সে চেষ্টা চলছে।
আজকের ফলাফল প্রকাশের পর কংগ্রেসের একাধিক প্রথম সারির নেতা কর্ণাটকেও জোট গড়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ার কথা বলেছেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, পশ্চিমবঙ্গের সাগরদীঘি বিধানসভা আসনের নির্বাচনের উপনির্বাচনেও আজ বামপন্থী সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী বায়রন বিশ্বাস ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীকে হারিয়ে আসনটি জিতে নিয়েছেন।
সাগরদীঘিতে বিজেপি এসেছে তৃতীয় স্থানে। বছর দুয়েক আগের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বা বামপন্থী দলগুলোর একজন প্রার্থীও জিততে পারেননি। স্বাধীনতার পর রাজ্য বিধানসভায় কোনও কংগ্রেস বা বাম সদস্য নেই, সে ঘটনাও ঘটেছিল প্রথমবারের মতো।
বামপন্থীদের সঙ্গে জোট ধরে রেখে সেই শূন্যতা অবশেষে কাটানোর পর পশ্চিমবঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী মন্তব্য করেছেন, 'আজ প্রমাণ হয়ে গেল মমতা ব্যানার্জিও অপরাজেয় নন।'
অর্থাৎ শুধু ত্রিপুরাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের সাগরদীঘিও এটাই প্রমাণ করল যে যেখানেই বিরোধী শক্তিগুলো একজোট হয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারছে এবং বিরোধীদের মধ্যে ভোট ভাগ ঠেকাতে পারছে, সেখানেই শাসক দল সমস্যায় পড়ছে।
বিজেপির জন্য কিছুটা দু:সংবাদ বয়ে এনেছে মহারাষ্ট্রের কসবা পেঠ আসনের উপনির্বাচনও। যেখানে তাদের বিধায়ক মুক্তা তিরকের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়েছিল। গত ২৮ বছর ধরে রাজ্যের এই আসনটি ছিল বিজেপির দখলে, কিন্তু আজ কংগ্রেসের প্রার্থী রবীন্দ্র ধাঙ্গেকর ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজেপিকে হারিয়ে কসবা পেঠ জিতে নিয়েছেন।
কয়েক মাস আগেই একনাথ সিন্ধে শিবসেনায় ভাঙন ধরিয়ে বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে ওই রাজ্যে নতুন সরকার গড়েছেন, ফলে কসবা পেঠ আসনের ফলাফল মহারাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন জোটের কাছেও একটা বড় ধাক্কা।