শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৭ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

‘নাই রস নাই, দারুণ দহন বেলা’

আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৩, ০৫:৩০

আমাদের এই অঞ্চলে শীতকাল যেন দুই দিনের অতিথি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অতিথি যেন দিনদিন আরও অস্থির হইয়া উঠিতেছে তাড়াতাড়ি বিদায় লইবার জন্য। সম্প্রতি নূতন একটি পূর্বাভাসে বলা হইয়াছে, এইবারের মার্চে তাপমাত্রার পারদ ব্যাপকভাবে চড়িতে পারে। কেবল আমাদের দেশেই এই অবস্থা নহে, শীতপ্রধান দেশগুলির অবস্থাও বেশ জটিল। এইবার জানুয়ারি মাসের প্রারম্ভেই ‘রেকর্ড-ব্রেকিং’ তাপমাত্রা প্রত্যক্ষ করিয়াছে ইউরোপের দেশগুলি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলিয়াছেন, জানুয়ারি মাসের উষ্ণতম দিন রেকর্ড করিয়াছে ইউরোপের অন্তত আটটি দেশ। ইউরোপের ইতিহাসে এমন ঘটনা অতীতে কখনো ঘটে নাই বলিয়া জানাইয়াছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ম্যাক্সিমিলিয়ানো হেরেরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের তাপমাত্রার তথ্য বিশ্লেষণ করিয়া দেখিয়াছেন, পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, বেলারুশ, চেক প্রজাতন্ত্র ও ফ্রান্সের মতো শীতপ্রধান দেশ রেকর্ড তাপমাত্রার সম্মুখীন হইয়াছে। পোল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকা কোরবিলোতে ১৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হইয়াছিল—যেই ধরনের অবস্থা সাধারণত মে মাসে অনুভূত হয়। এই রেকর্ড তাপমাত্রার কারণ কী—এই ব্যাপারে ব্রিটিশ আবহাওয়াবিদ অ্যালেক্স বার্কিল বলিয়াছেন, আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে উষ্ণ বাতাস তৈরি হইয়াছিল, যাহা ইউরোপে ছড়াইয়া পড়ে। যদিও অনেকে মনে করেন, শুধু উষ্ণ বাতাসই বিস্ময়করভাবে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ নহে, ইহার সহিত সম্পৃক্ত রহিয়াছে জলবায়ুর পরিবর্তন। আর ইহার জন্যই ত্বরান্বিত হইতেছে বিশ্ব উষ্ণায়নের। সারা বিশ্বেই অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ আরও প্রকট এবং চরম হইয়া উঠিতে শুরু করিয়াছে।

পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করিবার বিষয়টিকে বর্তমানে এই ধরিত্রীর বুকে মানুষের বাঁচা-মরার সহিত তুলনা করা হইয়া থাকে। এই ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা একটি ব্যাপারে একমত যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস করিতেই হইবে। যদিও সৃষ্টির শুরু হইতে এখন অবধি পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটিয়াছে শত সহস্রবার। ইহা প্রকৃতির একটি নিরন্তর খেলা। বিজ্ঞানীরা ধারণা করিয়া থাকেন, এখন অবধি পাঁচ বার পৃথিবীতে প্রাণের মহাবিলুপ্তি ঘটিয়াছে। আমরা নুহ নবীর (আ.) নৌকার কথা জানি, যখন পৃথিবীতে মহাপ্লাবন হইয়াছিল। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন, পৃথিবীতে জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্যই একেক সময় প্রাণের মহাবিলুপ্তি ও মহাপ্লাবনের মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়াছিল। কিন্তু প্রায় তিন শত বৎসর পূর্বে শুরু হওয়া শিল্পায়নের পর হইতে এখন অবধি পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রায় দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়িয়াছে। বিজ্ঞানীরা বলিতেছেন, জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীর স্বাভাবিক ঘটনা হইলেও উহা যত আস্তে ধীরে হইবার কথা, বৈশ্বিক শিল্পায়নের কারণে তাহা হইতেছে অতি দ্রুত। আর ইহাই মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হইয়া উঠিতেছে বলিয়া মনে করেন বিশ্বের বেশির ভাগ জলবায়ু বিষয়ক বিজ্ঞানীরা।

বিশ্বের যেই সকল দেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচাইতে বেশি ঝুঁকিতে রহিয়াছে, বাংলাদেশ তাহাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশে এখন দুর্যোগ বেশি হইতেছে, নদীভাঙন বাড়িতেছে, বেশি বেশি ঝড়, দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হইতেছে। সেই সঙ্গে উত্তরবঙ্গে তৈরি হইতেছে মরু শুষ্কতা এবং দক্ষিণবঙ্গে বাড়িতেছে লবণাক্ততা। এই সকল কিছুই হইতেছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো অবস্থা এখন—‘নাই রস নাই, দারুণ দহন বেলা।’ দুঃখের বিষয় হইল, এই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য যত কার্বন নিঃসারণ হয়, সেইখানে বাংলাদেশের মতো দেশগুলির দায় খুবই সামান্যই। কিন্তু ভোগান্তি অনেক বেশি। এইদিকে, কার্বন নিঃসারণ কমাইবার শর্তের মধ্যে বৈষম্যও দেখিতে পাইতেছে উঠতি শিল্পোদ্যোগী দেশসমূহ। কারণ, যাহারা ইতিপূর্বে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হইয়াছে, তাহারা এতকাল নির্বিচারে কার্বন নিঃসারণ করিয়াছে, কিন্তু যাহারা এখন শিল্প-কলকারখানার মাধ্যমে তাহাদের অর্থনীতিকে উন্নতির কাতারে লইয়া যাইতে শুরু করিয়াছে, তাহারাও সুযোগ চাহে। কিন্তু বিশ্বব্যাপীই যে জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটিতেছে এবং তাহা একটু দ্রুতই ঘটিতেছে—এই ব্যাপারে কাহারো দ্বিমত নাই। মনে রাখিতে হইবে, আমাদের একটাই প্লানেট। সুতরাং ‘প্লানেট-বি’ বলিয়া কিছু নাই বিধায় পৃথিবীকে রক্ষা ব্যতীত আমাদের সামনে বিকল্পও কিছু নাই।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন