নারীকে নিয়ে গল্প, উপন্যাস নাটক বহু লেখা হয়েছে। তবে নারীকে বোঝার, নারীসত্ত্বার খোঁজ পাওয়ার জায়গায় বরাবরই বাংলায় লেখা বইয়ের অভাব। নারীসত্ত্বা নিয়ে স্নিগ্ধা রেজওয়ানার গবেষণা গ্রন্থ 'নারীসত্তার অন্বেষণে' প্রকাশিত হলো ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে। শুধু তাই নয়। স্নিগ্ধা রেজওয়ানার গবেষণামূলক বইটি চিন্তার খোরাক জোগাতে সাহায্য করার পাশাপাশি গবেষণায়ও শিক্ষার্থীদের উৎসাহী করবে। বইটি লেখার সময় লেখক একজন নৃতাত্বিকের চোখে দেখেছেন সবকিছুকে। নৃবিজ্ঞানে গবেষণামূলক ভালো বাংলা বইয়ের অভাব রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইংরেজি বইয়ের অনুবাদ কিংবা মূল ইংরেজির ওপরই নির্ভর করতে হয়। তবে স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বেছে নিয়েছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে।
বইটি লেখার সময় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারীকেই দেখতে চেয়েছেন। সচরাচর নারীর বৈষম্য, নিপীড়ন এবং অত্যাচারকেই খুব বেশি বড় করে দেখা হয়। কিন্তু তারা যে ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং তার গতিবিধি কেমন হতে পারে তা নিয়ে কারোই মাথাব্যথা দেখা যায় না। স্নিগ্ধা রেজওয়ানা যেন এ বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি তুলে এনেছেন ছোটবেলা থেকেই বৈষম্যের শিকার হওয়া নারীর গল্প, বিবাহিত হওয়ার পর নতুন সম্পর্ক আবিষ্কার করা নারীর গল্প আবার বিধবা হওয়ার পরও কিভাবে নারী নিজেকে পুনর্গঠিত করেন। এমন অভিনব পদ্ধতিতে এই প্রথম বাংলায় কোনো বই লেখা হলো।
গবেষণায় মধ্যবিত্তকে বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ড. স্নিগ্ধা বলেন, 'যাতে আমার গবেষণার কাজ অংশগ্রহণকারী এবং গবেষকের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে দেয়।' ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত নারীর সত্তা নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়াকে লিঙ্গীয় সর্ম্পক—নারী শরীর, যৌনতা, মাতৃত্ব, শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক সম্পর্ক এবং মধ্যবিত্তের চৈতন্য কীভাবে নারীকে তার সত্তা গঠনে সক্রিয় করে তোলে সেটি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই বইতে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত নারীর সত্তা একইসাথে নারীর আত্মগত সচেতনতা এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিসরে নির্মিত এক ধরনের চেতনাবোধ। যেখানে নারী তার পারিপার্শ্বিক বাস্তবতার নিরিখে নিজ সত্তার আদল দানে সর্বদা সক্রিয় থাকে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সত্তার আত্মনির্মাণ ও পুনর্নির্মাণে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। মধ্যবিত্ত নারীর নানাবিধ প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে নারীর সত্তা নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ প্রেক্ষাপট উপস্থাপন এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য।
তিনি লিঙ্গীয় সম্পর্ক নির্ধারণে নারীর অবস্থান তুলে ধরেছেন, শুধু পুরুষের সঙ্গে তাদের প্রতিস্থাপন নয়। তিনি তুলে ধরেছেন কিভাবে লিঙ্গ সম্পর্ক সত্তার নির্মাণ ও পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখে। লেখকের মূল যুক্তি হল যে নারীর আত্ম-গঠন একটি জটিল এবং চলমান প্রক্রিয়া যা সমাজের মনোভাব, নিয়ম এবং প্রত্যাশা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। তিনি আরও যুক্তি দেন যে নারীর পরিচয় গঠন একটি রৈখিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি গতিশীল এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। বইয়ের একটি অংশে তিনি তুলে ধরেছেন কীভাবে একজন নারীর শরীর, যৌনতা এবং মাতৃত্ব তার সত্তার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং কীভাবে এই তিনটি বিষয় যে কোনো প্রেক্ষাপটে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। নারীত্বের নির্মাণে, বিশেষ করে, শরীরের প্রেক্ষাপট, যৌনতা এবং মাতৃত্ব শুধুমাত্র একজন নারীর নারীত্বের সাথে সম্পর্কিত নয় বরং তার সমগ্র জীবনের সাথে নারীত্বের অনুসন্ধানের জন্য একটি প্রভাব হিসেবে কাজ করে। বইয়ের একটি অংশে তিনি তুলে ধরেছেন কীভাবে একজন নারীর শরীর, যৌনতা এবং মাতৃত্ব তার সত্তার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং কীভাবে এই তিনটি বিষয় যে কোনো প্রেক্ষাপটে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। নারীত্বের নির্মাণে, বিশেষ করে, শরীরের প্রেক্ষাপট, যৌনতা এবং মাতৃত্ব শুধুমাত্র একজন নারীর নারীত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় বরং তার সমগ্র জীবনের সঙ্গে নারীত্বের অনুসন্ধানের জন্য একটি প্রভাব হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বইটির যে আগ্রহী পাঠকসমাজ রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বরং বইটিই যেন অনেক দেরিতে প্রকাশিত হয়েছে। না হওয়ার পেছনে অবশ্য কারণও রয়েছে। লেখকের কাজ লেখা। তিনি তার গবেষণার কাজে ব্যস্ত থাকবেন। লেখাটিকে কিভাবে আরও পরিশীলিত করা যায় সেদিকেই তার সব ধ্যানজ্ঞান। লেখকও সে কথাই বলেছেন, বইয়ের বাজারে, বইয়ের প্রচার-প্রচারণা সম্পর্কে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। আমি কোন উপন্যাসিকও না বা কবি ও নই, আমার আলাপ, চিন্তা সমাজ এবং চারপাশের বৈষম্য নিয়ে, এই বইটিও সেরকম একটি বই। তাই এই বই আপনাদের মনোরঞ্জনের খোরাক না হলেও চিন্তার খোরাক হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
স্নিগ্ধা রেজওয়ানাও তার বইটিতে সে পরিমিতবোধের পরিচয় রেখেছেন। অপেক্ষা করেছিলেন একটি প্রকাশনার আগ্রহের। এমনটাই তো দেশের প্রকাশনার দায়। তাদের নিজ দায়িত্বের জায়গাগুলো স্পষ্ট থাকলে এ ধরনের গবেষণামূলক বইয়ের অন্তর্ভুক্তি না হওয়ার কথা নয়। নৃতাত্বিকের দৃষ্টিতে লেখা হলেও উইম্যান এবং জেন্ডার স্টাডিজ অধ্যয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ বই হওয়ার কথা। বইটির দৃষ্টিকোণ প্রথম থেকেই অ্যাকাডেমিক। সাধারণ পাঠকের চোখে বিষয়টি প্রথমেই চোখে পড়বে। কিন্তু অ্যাকাডেমিক বইও যে আগ্রহজাগানিয়া হয়ে উঠতে পারে বইটি তার প্রমাণ। অ্যাকাডেমিয়ার জগত যখন সাধারণ পাঠকের কাছে উন্মুক্ত হবে এবং এর বিশ্লেষণী ও গবেষণামূলক প্রভাব মানুষ আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন তখনই তো গবেষণায় আগ্রহী হবে তরুণ গোষ্ঠী। স্নিগ্ধা রেজওয়ানা যেন সে কাজটিই করলেন এবং এমন একটি অসাধারণ বই পাঠকের কাছে নিয়ে এসেছে ঐতিহ্য। বইটির মূল্যও সাধ্যের ভেতর। ৩৭০ টাকা এর মূল্য নির্ধারিত হয়েছে। বইটি বইমেলার পাশাপাশি কলকাতা বইমেলাতেও পাওয়া যাবে।
নাহিদ আক্তার
শিক্ষক, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অফ সেন্ট পিটার্সবার্গ