চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় একটি অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় ছয় জন নিহত ও অন্তত ২০ জন আহত হয় গত শনিবার। এই ঘটনার রেশ না কাটিতেই গতকাল রাজধানী ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকার একটি ভবনে বিস্ফোরণ হইতে লাগা আগুনে দগ্ধ হইয়া মারা গেলেন তিন জন। আহত হইয়াছেন বেশ কয়েক জন, যাহারা এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রথম ঘটনাটি ঘটিয়াছে সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডের কারখানায়। এই কারখানায় মূলত মেডিক্যাল অক্সিজেন ও জাহাজ কাটার কাজে ব্যবহৃত অক্সিজেন তৈরি হয়। বিস্ফোরণের সময় কারখানাটির ভিতর ও বাহিরে প্রচুর অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত ছিল। আর দ্বিতীয় ঘটনাটির পিছনে চারটি কারণ দায়ী থাকিতে পারে বলিয়া জানাইয়াছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার। সম্ভাব্য এই চারটি কারণের মধ্যে রহিয়াছে—বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, জমিয়া থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বা এসি বিস্ফোরণ। এই ঘটনাটিকে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারের গ্যাস বিস্ফোরণের সহিত তুলনা করিয়াছে, যাহাতে নিহত হয় ১২ জন। জমিয়া থাকা গ্যাসের ঘনমাত্রা যদি ৫-১১ মাত্রার হয় এবং ইহা যদি ট্রিগার হয়, তাহলে এই ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিতে পারে। এই ট্রিগার ফ্যান ও এসিসহ যে কোনো সুইচের মাধ্যমেও হইতে পারে।
বর্তমান সময়টাকে অগ্নিকাণ্ডের মৌসুম বলা হয়। সাধারণত মাঘ-ফাল্গুনের হাওয়ার সঙ্গে আগুনের একটি যোগসূত্র রহিয়াছে। শীতে শুকাইয়া থাকা খড়কুটা, শুকনা পাতায় আগুন লাগিয়া যায় অতি সহজে এবং এই সময়কার বাতাসে সেই আগুন গতি পায় নিমেষে। প্রকৃতির এই চনমনে অবস্থায় অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপারে আমাদের সচেতন ও সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আমরা আবাসিক, কারখানা প্রভৃতি এলাকায় কতটা সচেতনতার পরিচয় প্রদান করিতেছি, তাহা একটি বড়ই প্রশ্নই বটে। দেখা যায়, কোথাও ভয়াবহ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটিলে আমরা কিছু দিন কিছুটা নড়িয়া-চড়িয়া বসি। তাহার পর আবার যেইকার সেই অবস্থা দাঁড়াইয়া যায়। সকল কিছু মিলাইয়া যায় বিস্মৃতির অতল গর্ভে। ঢাকার চুড়িহাট্টার ভয়াবহ ও লোমহর্ষক অগ্নিকাণ্ডের কথা কি আমরা মনে রাখিয়াছি? গত বৎসরের ৪ জুন সীতাকুণ্ডেরই একটি ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫০ জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হইয়াছিল। দুঃখজনক বিষয় হইল, অনেক সময় দেখা যায়, সুপারিশ বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টই প্রকাশিত হয় না। পুরান ঢাকায় প্রায়শ বিভিন্ন কেমিক্যাল দোকান বা কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটিতে দেখা যায়। কিন্তু সেইগুলি আবাসিক এলাকা হইতে সরাইয়া নেওয়া তথা, একটি সুন্দর ব্যবস্থাপনা গড়িয়া তুলিবার ব্যাপারেও আমাদের গরজ আছে বলিয়া মনে হয় না। আমরা বরাবরই শহরের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে জোনিং পদ্ধতির ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করিয়া আসিতেছি। কিন্তু পুরান ঢাকার কথা না হয় বাদই দিলাম, শহরের বর্ধনশীল ও উন্নয়নশীল এলাকায় জোনভিত্তিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে আজও গুরুত্ব দেওয়া হইতেছে না। অগ্নিকাণ্ডের মৌসুমে মানুষকে সচেতন করিবার সরকারি উদ্যোগও তেমন চোখে পড়িতেছে না। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের মহড়ার কথাও আজকাল তেমন শুনিতে পাওয়া যায় না।
বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে চলতি মার্চ ছাড়াও আগামী এপ্রিল মাসে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়িয়া যাইতে পারে। অতএব, জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াইতে অফিস-আদালত, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা সর্বত্র জ্বলন্ত সিগারেট ও ম্যাচের কাঠি যত্রতত্র না ফেলা, মানসম্মত বৈদ্যুতিক তার ও ইলেকট্রিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা, তাহা নিয়মিত পরীক্ষানিরীক্ষা করা, ভবন তৈরিতে আইন মানা, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রাখা, এই বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ব্যাপারে আমাদের মধ্যে এখন হইতেই সচেতনতা গড়িয়া তুলিতে হইবে।