আধুনিক জীবনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুবিধা ব্যতীত সহজ ও স্বাভাবিকভাবে একটি দিনও পার করা সম্ভব নহে। প্রযুক্তির সুবিধা যেমন আলাদীনের চেরাগের মতো জাদুকরী, তেমনি অসতর্কতায় ইহা আমাদের জীবন ধ্বংসের কারণ হইয়া উঠিতে পারে। সুতরাং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করিতে হয় যাবতীয় সেফটি রুলস যথাযথভাবে মানিয়া বুঝিয়া। বিজ্ঞানের প্রকৌশল সুবিধাকে বলা যাইতে পারে—ভয়ংকর সুন্দর। ভয়ংকর সুন্দরকে অত্যন্ত সাবধানে সামলাইতে হয়। না সামলাইলে কী হয়, তাহার কয়েকটি ঘটনা সম্প্রতি রাজধানী ঢাকাতে ঘটিয়া গিয়াছে। রাজধানীর গুলিস্তানের বিআরটিসি বাস কাউন্টারের দক্ষিণ পাশে সিদ্দিকবাজারের কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসাবে পরিচিত সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হইয়াছে সেফটি রুলস অবহেলার কারণেই। ইতিপূর্বে ঢাকার সাইন্সল্যাবরেটরি এলাকায় একটি তিনতলা বাণিজ্যিক ভবনে ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি অক্সিজেন কারখানায় বড় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়াছে। প্রাথমিকভাবে সকল দুর্ঘটনাতেই বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে ‘জমিয়া থাকা গ্যাসের’ বিষয়টিকে দায়ী করা হইতেছে। ইহা ছাড়াও ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারে ঘটিয়া যাওয়া বিস্ফোরণের কথা আমরা স্মরণ করিতে পারি। সেইখানেও তিনতলা ভবনের নিচতলায় জমিয়া থাকা গ্যাস হইতে বিস্ফোরণ ঘটিয়াছিল। এমনকি ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যু হইয়াছে, ইহার তদন্তে সিআইডি জানাইয়াছে—মসজিদের ভিতরে গ্যাস ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ছিল। গ্যাসলাইনের লিকেজ দিয়া বাহির হইয়া আসা গ্যাসের উপর বিদ্যুতের স্পার্ক পড়িতেই বিস্ফোরণ ঘটে।
অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলিয়া থাকেন, সাধারণত কোনো আবদ্ধ জায়গায় যদি গ্যাসের মাত্রা ৫ শতাংশ হইতে ১৭ শতাংশ হয়, তাহা হইলে কোনোভাবে আগুনের স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শ পাইলেই বিস্ফোরণ ঘটিবে। এই আগুন হইতে পারে দিয়াশলাই, জ্বলন্ত সিগারেট, কিংবা সুইচবোর্ডের সামান্য স্পার্ক। যদিও সিদ্দিকবাজারের কুইন স্যানিটারি মার্কেটের সাততলা ভবনের বিস্ফোরণের সুস্পষ্ট কারণ এখনো বলা যাইতেছে না। তবে সম্ভাব্য কয়েকটি কারণ হিসাবে বলা হইতেছে—ভবনের মাটির নিচে পানির ট্যাংক হইতে গ্যাস নির্গত হইতে পারে; দুইটি ভবনের মধ্যখানে একটি সেপটিক ট্যাংক ছিল, সেইখান হইতেও গ্যাস নির্গত হইতে পারে; বিচ্ছিন্ন হওয়া কোনো গ্যাসের লাইন হইতে গ্যাস জমিতে পারে বা দেওয়ালে মিথেন গ্যাস জমিয়া থাকিতে পারে; পয়োনিষ্কাশন লাইনের পাইপ লিকেজ হইয়া গ্যাস জমিতে পারে এবং ভবনে থাকা বড় জেনারেটর হইতেও কোনোভাবে গ্যাস জমিতে পারে। বিপদের কথা হইল—এই সমস্যা রাজধানীর সিংহভাগ ভবনেই থাকিবার আশঙ্কা রহিয়াছে। অনেক বিশেষজ্ঞই এখন বলিতেছেন—পুরা নগরী বিপজ্জনক মিশ্র ব্যবহারের কারখানা। একই ভবনে রেস্তোরাঁ, আবাসিক কিংবা ক্যামিক্যাল সামগ্রীর দোকান। সকলেই জানেন যে, রাজধানী জুড়িয়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অসংখ্য বৈধ-অবৈধ লাইন ছড়াইয়া-ছিটাইয়া আছে, যাহা অনেক জায়গাতেই লিকেজ হয়। বিশ্লেষকরা বলিতেছেন—গ্যাস, পানি ও স্যুয়ারেজের লাইনে ত্রুটি এবং গ্যাস ও বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটই বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করিতেছে। সুতরাং এই ধরনের মারাত্মক বিস্ফোরণ খুব অবাক করা বিষয় নহে। এই সকল বিস্ফোরণের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিতেছে যে, শহরটি আসলে কতখানি অনিরাপদ! এই শহরের হাজার হাজার অনিরাপদ ও নিয়ম না মানা ভবনগুলি যেন টাইমবোম্ব! উহারা রহিয়াছে সামান্য স্ফুলিঙ্গের অপেক্ষায়।
দুঃখজনকভাবে, এই সকল বিষয় দেখিবার জন্য সত্যিকারের তদারকি নাই। ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা কত—ইহার কোনো হিসাব কাহারো নিকটই নাই। অথচ এই সকল বিপদের বিষয়াদি দেখিবার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থার মধ্যে রহিয়াছে—বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরণ পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইহা ছাড়া ব্যাংক এবং ইনসিওরেন্স কোম্পানিরও দায়বদ্ধতা রহিয়াছে। সুতরাং দায় কেবল ভবন কর্তৃপক্ষের নহে। এই দায় সম্মিলিত অবহেলার।