২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দেশের আটটি জেলার ১০টি সরকারি হাসপাতালে একযোগে অভিযান পরিচালনা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। হাসপাতালগুলিতে ৪০ শতাংশ চিকিৎসককেই অনুপস্থিত পাওয়া যায়। উপজেলা পর্যায়ের চিত্র আরও করুন—প্রায় ৬২ শতাংশ চিকিৎসককে কর্মস্থলে পাওয়া যায় নাই। অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্বাস্থ্যসেবা খাতে এই ধরনের চিত্রের উত্তরণ ঘটাইতে পরবর্তীকালে ডিজিটাল হাজিরার ব্যবস্থা ঢালিয়া সাজানো হয়। কিন্তু তাহাতেও কাজ হয় নাই। বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক অনুপস্থিতির চিত্র প্রায়ই দৃষ্টিগোচর হইতেছে। অথচ প্রাইভেট ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলিতে তাহারা ঠিকই দেদার সেবা বিতরণ করিতেছেন! ইহার ফলে সরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হইতেছে। সেবাপ্রার্থীরা চিকিৎসা লাভের অধিকার হইতে বঞ্চিত হইতেছে। এই বাস্তবতা সেই সকল চিকিৎসকেরও অজানা নহে—যেই হেতু তাহারাও এই দেশেরই নাগরিক। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাহাদের একাংশকে স্বীয় কর্মদায়িত্বমুখী করা যাইতেছে না কোনোমতেই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই ব্যাপারে বারংবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করিলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটিতেছে না। ইহা অতি উদ্বেগজনক চিত্রই বটে।
সম্প্রতি দেখা গিয়াছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কোটি মানুষের একমাত্র বিশেষায়িত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রায়শই অনুপস্থিত থাকিতেছেন। ইহার ফায়দা লুটিতেছে একটি শ্রেণি। এই মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ শ্রেণি হইতে শুরু করিয়া শীর্ষ পদ পর্যন্ত সকলেই কাগজে-কলমে চাকরিরত থাকিলেও অধিকাংশই মূলত বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অর্থের বিনিময়ে সেবা প্রদান করিয়া থাকেন বলিয়া আমরা জানিতে পারিয়াছি। হাসপাতালের সম্মুখে এবং বরিশাল নগর জুড়িয়া গড়িয়া উঠা প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিকগুলিতে চলিতেছে তাহাদের রমরমা বাণিজ্য। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকসহ সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মেডিক্যালমুখী করিবার জন্য বারবার শের-ই-বাংলা মেডিক্যালের পরিচালক নির্দেশ দিলেও সেই অফিস আদেশে কর্ণপাত করিতেছেন না অনেকেই। কী অদ্ভুত কথা! সত্যি বলিতে, এই ধরনের চিত্র দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলায়! আমরা বেসরকারি চিকিৎসাসেবা বিকাশের পক্ষপাতী। কিন্তু সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির সিনিয়র চিকিৎসকের কর্মস্থলে অনুপস্থিতি ও দায়িত্বে অবহেলা মানিয়া নেওয়া যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঠিক নজরদারি না থাকায় ইন্টার্ন, নার্স হইতে শুরু করিয়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণেই চলে সেবা কার্যক্রম। তাহারা যতক্ষণ হাসপাতালে অবস্থান করেন, পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য রোগীদের বাহিরের প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিকে পাঠাইতে একপ্রকার বাধ্য করেন বলিয়া অভিযোগ রহিয়াছে! ক্ষেত্রবিশেষে, হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শিফট বণ্টনপূর্বক নিজেরাই নিয়মকানুন তৈরি করিয়া সর্বক্ষেত্রে বাণিজ্যের আসর খুলিয়া বসে এই দুষ্টচক্র! দেশের সরকারি হাসপাতালসমূহ এমনিতেই প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে ভুগিতেছে, এই অবস্থায় উপরিউক্ত শ্রেণির দায়িত্বরত চিকিৎসকরাও যদি স্ব-স্ব কর্মস্থলে না থাকেন, তাহা হইলে সরকারি হাসপাতালগুলি চলিবে কীভাবে?
চিকিৎসাসেবা মহান পেশা। সম্মানের পেশা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা থাকিলেও প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা পৌঁছাইয়া দিতে সরকার যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু এই ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হইতেছে একশ্রেণির চিকিৎসকের কর্মস্থলে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে অনীহা। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের অধিকার—এই কথাটি আমাদের সবাইকে মনে রাখিতে হইবে। যাহারা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকিয়া কর্মে ফাঁকি দিতেছেন, তাহাদের উদ্দেশে আমরা পরিষ্কার করিয়া বলিতে চাই, মানবসেবার চেতনা না থাকিলে ও কর্তব্যনিষ্ঠ না হইলে সরকারি চিকিত্সাপ্রতিষ্ঠান হইতে তাহাদের পদত্যাগ করা করা উচিত। জনগণের করের টাকায় বেতন-ভাতা লইয়া তাহারা জনগণের সহিত আর যাহাই হউক প্রতারণা করিতে পারেন না। স্বাস্থ্য খাতের এই অবক্ষয় অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারি ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ানদের এইভাবে দায়িত্ব অবহেলা জাতির জন্য লজ্জাজনক। এই প্রবণতা যে করিয়াই হউক, অবশ্যই বন্ধ করিতে হইবে। শুধু চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গই নহে, অন্য পেশাদার ব্যক্তিদেরও কর্মস্থলে অনুপস্থিতি দেশ ও জাতি সর্বোপরি নিজেকে ঠকাইবার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নহে।