বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩, ১৫ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান

আপডেট : ১১ মার্চ ২০২৩, ০৪:০০

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে গত বৃহস্পতিবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলচ্চিত্র নির্মাণ লইয়া বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কিছু কথা বলিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, একটা সিনেমা একজন মানুষের জীবনকে পালটাইয়া দিতে পারে, একটা সমাজকে পালটাইয়া দিতে পারে। তিনি  বলিয়াছেন এই ধরনের সিনেমা তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের শিল্পসাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতের সহিত আজন্ম সংশ্লিষ্ট। এই জন্যই তিনি যথার্থ উপলব্ধি করিতে পারেন যে, সকলের মধ্যেই আলাদা একটা মেধা ও চিন্তাশক্তি রহিয়াছে। একটা আর্টিস্টিক ও শৈল্পিক মেধা রহিয়াছে। তাহাদের মাধ্যমে জীবনধর্মী যেই সকল সিনেমা তৈরি হয়, সেইগুলি মানুষকে আকর্ষিত করে। প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করিয়াছেন, ভালো চলচ্চিত্র, শিল্পসম্মত, জীবনঘনিষ্ঠ, চিন্তাশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রতি বৎসর সরকার যেই অনুদান দেয়, তাহা পর্যাপ্ত নহে। তিনি বলিয়াছেন, অনুদানের চলচ্চিত্রে টাকার অঙ্ক বাড়ানো হইবে। বর্তমানে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার জন্য ৭৫ লক্ষ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমার জন্য সরকার ২০ লক্ষ টাকা অনুদান দেয়। আগামী বাজেটে তাহা বৃদ্ধির উদ্যোগ লইবার কথা তিনি বলিয়াছেন। অত্যন্ত সাধু উদ্যোগ নিশ্চয়ই। যদিও চলচ্চিত্রের অনুদানের হার কয়েক বৎসর পরপরই বৃদ্ধি করা হয়। ১০ বৎসর পূর্বে যেই পরিমাণ অর্থ অনুদান হিসাবে দেওয়া হইত, এখন তাহার প্রায় দ্বিগুণ দেওয়া হয়। মূল্যস্ফীতি, সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধি—সকল মিলাইয়া অনুদানের অর্থ একটু একটু করিয়া আমরা বৃদ্ধি পাইতে দেখিয়াছি। ইহা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু যাহা বলিবার তাহা প্রধানমন্ত্রী আরও স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিয়াছেন। প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিয়াছেন অনুকরণ না করিয়া মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরির।

আমরা জানি, চলচ্চিত্র অনুদান নীতিমালায় প্রথম কথাটিই হইল—চলচ্চিত্রশিল্পে মেধা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা। এই জন্য এমন সকল চিত্রনাট্যের অনুদান অনুমোদন করা হয়, যাহাদের এই শৈল্পিক ও সৃজনশীল দিক রহিয়াছে। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদান নীতিমালা-২০১২ (সংশোধিত ২০১৬)-তে বলা হইয়াছে, প্রতি বৎসর প্রামাণ্যচিত্রসহ সর্বোচ্চ পাঁচটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে অনুদান প্রদানের জন্য বিবেচনা করা হইবে, সেইখানে চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান প্রদানের সংখ্যা গত কয়েক বৎসরে যথেষ্ট বৃদ্ধি পাইয়াছে। এখন ১৯ হইতে ২০টি চিত্রনাট্যকে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুদান দেওয়া হইতেছে। ইহাও অত্যন্ত ইতিবাচক নিঃসন্দেহে। কিন্তু সংখ্যাবৃদ্ধির পাশাপাশি মানবৃদ্ধির ব্যাপার না ঘটিলে তাহা হয় অত্যন্ত দুঃখজনক। এবং এই দুঃখজনক ঘটনাই আমরা দেখিতেছি। যেইখানে অনুদানের মূল উদ্দেশ্য হইল চলচ্চিত্রশিল্পে মেধা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা, সেইখানে বাণিজ্যিক ঘরানার অনুকরণদুষ্ট চিত্রনাট্যকেও অনুদানের জন্য নির্বাচিত করা হইয়াছে। যদিও বলা হইয়াছিল কোভিড-১৯-এর কারণে চলচ্চিত্রশিল্পে বাণিজ্যিক ছবির ক্ষতি হইবার জন্য সেই ক্ষতিপূরণের লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ছবিকেও অনুদানের জন্য বিবেচনা করা হইয়াছে—কিন্তু ইহা এখন ‘নিয়ম’ হইয়া উঠিতে পারে না। কোভিডের পরের বৎসর বিশেষ বিবেচনায় ইহা মানিয়া লইয়া যায়, কিন্তু এখন হইতে অনুদানের জন্য অবশ্যই চলচ্চিত্রশিল্পে মেধা ও সৃজনশীলতাকে উত্সাহিত করিবার বিষয়টিই সম্পূর্ণভাবে বিবেচনা করা নীতিমালাপন্থি হইবে।

আমাদের মনে রাখিতে হইবে, চলচ্চিত্র অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং অসংখ্য শিল্পের সম্মিলনের একটি বিস্ময়কর সৃজনধারা। ইহাতে আর্ট যেমন আছে, তেমনি আছে মানুষের জীবনকে পালটাইয়া দেওয়ার ক্ষমতা। এই আর্ট এবং ক্ষমতা কোনোটাই বাণিজ্যিক বা অনুকরণদুষ্ট চলচ্চিত্রে নাই। সত্যজিৎ রায় নিজের সর্বস্ব ব্যয় করিয়াও তাহার ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটির নির্মাণ শেষ করিতে পারেন নাই। তাহার পাশে তখন আগাইয়া আসিয়াছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অতঃপর ইহা হইয়া উঠিয়াছিল বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র। আমাদের প্রথম সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ও অত্যন্ত নামকরা শিল্পসৃজনময় চলচ্চিত্র। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর কথা আগামী দিনে যথাযথভাবে মানিতে হইবে চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদানের ক্ষেত্রে। অনুদান লইয়া ইতিপূর্বে অনেক বিতর্ক হইয়াছে। আন্দোলনও হইয়াছে। একটি মহত ও ভালো উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তিবর্গের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া উচিত নহে।

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন