শনিবার, ০১ এপ্রিল ২০২৩, ১৭ চৈত্র ১৪২৯
দৈনিক ইত্তেফাক

রাজধানীবাসীর জরুরি স্বাস্থ্যসেবা : প্রস্তুতি ও করণীয়

আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৩, ০০:১৭

চিকিৎসকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা বলতে আমরা দুই ধরনের চিকিৎসাসেবাকে বুঝে থাকি—মেডিক্যাল ও সার্জিক্যাল। সার্জিক্যাল বলতে যেসব রোগীর চিকিৎসায় সাধারণত শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, যেমন—অগ্নিদগ্ধ, সড়ক দুর্ঘটনার রোগী, উঁচু কোন স্থান থেকে পড়ে যাওয়া, ধারালো-ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে আঘাত, খালি হাতে নির্যাতন ইত্যাদিকেই বুঝি। অন্যদিকে মেডিক্যল জরুরি স্বাস্থ্যসেবা বলতে সেই সমস্ত শারীরিক অবস্থাকেই বুঝি, যেখানে শল্য চিকিৎসা লাগে না, কিন্তু অতিদ্রুত স্বাস্থ্যসেবার ছাতার নিচে না আনলে রোগীর প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা আছে। এগুলোর উদাহরণ হার্টঅ্যাট্যাক, স্ট্রোক, বিষপান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সংখ্যায় নগণ্য হলেও পানিতে পড়া, সাপ-মৌমাছি-ভিমরুল ইত্যাদি কীটপতঙ্গের দংশন, এমনিক বজ্রপাতে আহত রোগীও মেডিক্যাল ইমার্জেন্সির আওতাধীন। 

রাজধানীর চারদিকে বেশ কিছু সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি  হাসপাতাল রয়েছে। এসব স্বাস্থ্যকে বিনা পয়সায় অথবা সহনীয় মূল্যে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। রাজধানীর এক প্রান্তকে যদি উত্তরা বিবেচনা করি, তার কাছেই  কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল রয়েছে। পুরান ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ, প্রান্তে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ, মহানগরীর কেন্দ্রে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ, বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো সবই জেনারেল হাসপাতাল, অর্থাৎ সব ধরনের রোগের সাধারণ চিকিৎসা করা হয়। বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে বার্ন ইনস্টিটিউট, বারডেম, চক্ষু হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, হূদেরাগ ইনস্টিটিউট, মানসিক হাসপাতাল  উল্লেখযোগ্য।

সুষম চিকিৎসাসেবা বলতে শুধু চিকিৎসকের গুণমান বা সংখ্যাগত মানকেই বোঝায় না, বরং চিকিত্সাসেবী ব্যক্তিবর্গ যেমন—নার্স, প্যারামেডিকস, রেডিওগ্রাফার, ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান, এমনকি হাসপাতাল ক্লিনারের পেশাগত মানদণ্ডকেও বোঝানো হয়। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে আইসিইউ চিকিৎসাসেবা বিশেষভাবে জড়িত। কোভিড যখন অতিমারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে, তখন রাজধানীর আইসিইউ নিয়ে দুই রকম অবস্থা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তখনকার বিদ্যমান কাঠামো অনুযায়ী যে কয়টি আইসিইউ ছিল, সেগুলো আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে সক্ষম হয়। এমনকি সম্পূর্ণ নতুন এই রোগের চিকিৎসায় ‘কোভিড ডেজিগনেটেড আইসিইউ’তে রোগীর আরোগ্যের হার পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু একসঙ্গে এত বিশালসংখ্যক রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো পর্যাপ্তসংখ্যক বেড ছিল না। অনেক সাধারণ বেডকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অল্প সময়ের জন্য ‘ইমপ্রোভাইজ আইসিইউ’ তৈরি করা হয়েছিল। একটি আইসিইউ বেড বা কার্যকর করা খুব সহজবোধ্য কাজ নয়। সে জন্য চিকিৎসকের বিশেষ ট্রেনিং, ক্ষেত্রবিশেষে ডিগ্রি প্রয়োজন। তেমনি নার্স, আইসিইউ অ্যাসিস্ট্যান্টদের বিশেষ প্রশিক্ষণ, ক্ষেত্রবিশেষে তাদের শিক্ষাকাঠামো অনুযায়ী ডিগ্রিরও প্রয়োজন হতে পারে। বিষয়টিতে ব্যাপক অর্থযোগের সঙ্গে দীর্ঘ সময়ও লাগতে পারে। এছাড়া যুগোপযোগী চিকিৎসা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন। এগুলোর অধিকাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে প্রিশিপমেন্ট থেকে শুরু করে ইনস্টলেশন পর্যন্ত ব্যাপক কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। 

জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে শুরু হতে হয়। ধরা যাক, বহুতল ভবনের দশম তলায় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ১১ তলা থেকে লাফ দিলে নিশ্চিত মৃত্যু। ১১ তলা বা তার ওপরের বাসিন্দারা প্রথমেই প্রচণ্ড মানসিক বিকারের শিকার হয়। তাদের তাৎক্ষণিক সাহস জোগানো সামগ্রিক চিকিত্সাসেবার অংশ। সেল্ফ মোটিভেশনের জন্য ইন্টারনেটে প্রচুর ভিডিও পাওয়া যায়। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেটকে ফেসবুকের চোরাগলি থেকে বের করে এনে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার তথ্য-উপাত্ত হিসেবে ব্যক্তিগত-পারিবারিক-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যবহার করতে হবে। হাল জমানায় হেল্পলাইন চমৎকার মাধ্যম। এছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে অনেক চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠান টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে জরুরি  স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে। স্মার্ট ফোন রাজধানীবাসীর অনেক  নিম্নবিত্তদের কাছেও দেখা যায়। 

পুরোনো কথায় আবার ফিরে আসি। ঢাকা মেডিক্যালসহ সরকারি সব চিকিত্সাপ্রতিষ্ঠানে জরুরি বিভাগ আছে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য চিকিৎসক ও চিকিত্সাসেবীরা রোস্টার ডিউটি পরিচালনা করার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের চেষ্টা করেন। বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা ব্যয়বহুল বলে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবিধানে স্বাস্থ্যকে ‘সবার জন্য অধিকার’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই বেসরকারি হাসপাতালে আর্থিকভাবে অসচ্ছল কোনো অসুস্থ ব্যক্তি  জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিতে গেলে উক্ত প্রতিষ্ঠান সহনীয় মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে বাধ্য। কোনো ধরনের অযুক্তি-কুযুক্তি যেন জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে, সেটি সংশ্লিষ্ট সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। 

একজন অগ্নিদগ্ধ রোগী বার্ন ছাড়াও স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসায় সেখানে অর্থোপেডিক, চক্ষু, নাক-কান-গলা এমনকি হূদেরাগের চিকিৎসা থাকা বাঞ্ছনীয়। যদি সাধারণ চিকিৎসা প্রদানকারী হাসপাতালে সেগুলো না থাকে, তবে সেই সব বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠিয়ে তার চিকিৎসা করতে হবে। জরুরি স্বাস্থ্যসেবার রোগী গভীর মনোদৈহিক রোগে ভোগে। রোগীর মানসিক চিকিৎসা, দীর্ঘমেয়াদি কাউনসেলিং নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী ও রোগীর পরিবার বিভিন্ন ধরনের খরচের মধ্যে পড়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায়। এ ধরনের  রোগীকে দীর্ঘমেয়াদি ও মূল্যবান ওষুধ সেবন করতে হয়। সামগ্রিক চিকিৎসা সফল করতে গেলে সেই দিকেও নজর দিতে হবে।  

জরুরি রোগীকে হাসপাতালে আনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স-সেবা অত্যাবশ্যকীয়। এই সেবাকে বাণিজ্যিকীকরণ থেকে মুক্ত করা ও হালনাগাদ প্রযুক্তিনির্ভর অ্যাম্বুলেন্স ‘চাহিবা মাত্র দিতে বাধ্য থাকিবে’র মতো সুন্দর ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।  

দমকলব্যবস্থা, সড়কব্যবস্থ্যা, নগরকাঠামো, ভূমিকম্প প্রতিরোধবান্ধব দালান-কোঠার পরিবর্তন-পরিবর্ধন মৃত্যুর মুখোমুখি রোগীকে দ্রুত জরুরি স্বাস্থ্যসেবার অধীনে আনতে পারে। জরুরি চিকিৎসা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সেক্টরের কাজ নয়। বরং এর সামগ্রিক ব্যবস্থাকে একটি ছাতার নিচে এনে যুগোপযোগী প্রযুক্তি আর গতিশীল প্রশাসনের মাধ্যমে এরূপ সেবাকে আরো সহজলভ্য ও গতিশীল করতে হবে।  

লেখক : ক্লাসিফাইড স্পেশালিস্ট, ফার্মাকোলজি

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন