কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের স্থানীয় এলাকাবাসীর সহিত সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধ কোনো নূতন সমস্যা নহে। মাঝেমধ্যে আমাদের দেশে বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সহিত স্থানীয় অধিবাসী বা ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিতে দেখা যায়। দীর্ঘমেয়াদি এই সমস্যাকে নানা দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়। এমনকি এইরূপ উত্তেজনা সৃষ্টির পিছনে অনেক সময় রাজনীতির ইন্ধনও কাজ করিয়া থাকে। এই জন্য বিষয়টির গভীরে না গেলে যে কোনো মন্তব্য করা কঠিন। বর্তমানে অন্তত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অস্থিরতা বিরাজ করিতেছে। এই অস্থিরতার পশ্চাতে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় নাগরিক উভয়েরই অহমিকা ও অপরিণামদর্শিতা বহুলাংশে দায়ী। কেননা স্থানীয় এলাকাবাসী মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটি একসময় তাহাদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তি ছিল। সেইখানে তাহাদের অধিকার অধিক। ইহা ছাড়া তাহারা মনে করেন, তাহারা একশ্রেণির ছাত্রনেতার চাঁদাবাজি, ফাউ খাওয়া, বকেয়া ইত্যাদি ঘটনায় নির্যাতনের শিকার। আবার শিক্ষার্থীরা মনে করেন, স্থানীয় লোকেরা মূর্খ ও অশিক্ষিত। তাহারা গায়ে পড়িয়া ঝগড়া করিতেছে। স্থানীয় সন্ত্রাসী-মাস্তানরা তাহাদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাইতেছে। ইহাতে সামান্য ঘটনা হইতেই অনেক সময় বড় ধরনের অঘটনের সূত্রপাত হয়।
সম্প্রতি ঘটিয়া যাওয়া তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এইরূপ অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করিলে বিষয়টি সম্যক উপলব্ধি করা যাইবে। সর্বশেষ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিক্ষার্থীর উপর স্থানীয় বখাটেদের হামলায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ইহার প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে। স্থানীয় কয়েক জন যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের ভিডিও করিতেছিল। ইহার প্রতিবাদ করিতেই বিবাদ শুরু হয়। এইদিকে সিলেটের লিডিং বিশ্ববিদ্যালয়েও স্থানীয় লোকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘাতের খবর পাওয়া গিয়াছে। সেইখানে ভিসিকে অবরুদ্ধ করা হইয়াছে। তবে সবচাইতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি ছিল বিপজ্জনক। কিছুদিন পূর্বে তুচ্ছ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের সহিত আশপাশের ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসীর সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বিক্ষোভে উত্তাল হইয়া পড়ে। সেইখানেও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষার্থীরা ভিসি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করিয়া রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন রেললাইনে আগুন লাগাইয়া দেয়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনিতে রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। আমরা ইহার পূর্বেও দেখিয়াছি, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা আশপাশের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীদের সহিত বিরোধে জড়াইয়া পড়িয়াছে। ইহাকে কেন্দ্র করিয়া সংঘাত-সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাও ঘটিয়াছে। দেশের অন্যান্য স্থানেও বিভিন্ন সময় এমন ধরনের ঘটনার খবর আমরা শুনিতে পাই।
স্থানীয় এলাকাবাসীর সহিত শিক্ষার্থীদের এইরূপ উত্তেজনা ও সংঘাতের খবর খুবই দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। এই ব্যাপারে উভয় পক্ষেরই সংযত হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীরা হইল আবেগপ্রবণ ও অন্যায়ের বিরোধী। তাহারা সহপাঠীদের উপর কোনো প্রকার অন্যায় আচরণ বরদাস্ত করিতে পারে না। কেননা হলে থাকিবার কারণে তাহাদের মধ্যে সহজেই ঐক্য ও সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়। তাহার পরও অনেক সময় ভুল তথ্য দিয়া তাহাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। অনেক সময় দেখা যায়, একশ্রেণির ছাত্রনেতাকর্মী স্থানীয় মহল্লায় বিবাহ-শাদি করিয়া সেইখানে প্রভাব বিস্তার করেন যাহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা যায়। আর ছাত্রসংগঠনসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের জেরে এইরূপ অঘটন ঘটিয়া যায়; কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর তাহা বুঝিয়া উঠিতে সময় লাগে। আমরা বিভিন্ন সময় দেখিয়াছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহে হামলা চালাইয়া একটি বিশেষ ছাত্রসংগঠনের স্বার্থে স্থানীয় এলাকাবাসীকে ব্যবহার করা হইয়াছে যাহাতে সেইখানে তাহাদের দখলদারিত্ব কায়েম হয়।
অতএব, কেহ যাহাতে এইভাবে ব্যবহৃত না হইতে পারে, সেদিকে সতর্ক ও সচেতন থাকা প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে যে বা যাহারাই অপরাধ করুক না কেন, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা লইলে এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা কমিয়া যাইবে। ইহা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ও ইহার আশপাশে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের যে ঘটনা ঘটিতে দেখা যায়, তাহাও বন্ধ করা দরকার। স্থানীয় প্রশাসন কার্যকর ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থা লইলে এই সমস্যা ক্রমান্বয়ে দূর হইতে পারে।