সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘বাংলাদেশ বিজনেস সামিট-২০২৩’। এতে অংশগ্রহণকারী বক্তারা বলেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি অনেকটাই পালটে গেছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বর্তমানে দেশে বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, নীতিনির্ধারকসহ বিদেশ থেকে আগত উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে নিঃসন্দেহে। এজন্য আন্তর্জাতিক মানের বিনিয়োগসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশে পোশাক ও বস্ত্র, খাদ্যপণ্য, অবকাঠামো, ডিজিটাল ইকোনমি, এনার্জি সিকিউরিটি, কৃষি, হালকা প্রকৌশল, প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলন, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। এখানে উল্লেখ্য যে, করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক সংকট ও মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো করছে। সম্প্রতি আমেরিকায় পরপর তিনটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। ফলে বিভিন্ন দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে; কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো—এর মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি একটু একটু করে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের চাহিদা বাড়ায়, সার্বিক রপ্তানিতে বড় উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। নানা সংকোচন নীতি গ্রহণের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবার বাড়তে শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের কল্যাণের জন্য চারটি মাইলফলক নির্ধারণ করেছেন। প্রথমটি ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প, যা এখন একটা ভালো অবস্থানে রয়েছে, দ্বিতীয়টি ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জন, তৃতীয়টি ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং চতুর্থটি ২১০০ সালের ডেলটা প্ল্যান। সব নাগরিককে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত (এসডিজি-১ দারিদ্র্য অবসান এবং এসডিজি-২, জিরো হাঙ্গার অর্জন) একটি উন্নত বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে হবে এবং বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে সমুন্নত রাখতে হবে। বাংলাদেশের সম্পদ সীমিত, ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল।
ইউরোপে সার্বিকভাবে আমাদের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। মন্দার বাজারেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানি বাড়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার, তৃতীয় যুক্তরাজ্য এবং চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে কানাডার বাজার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি অর্থাৎ গত সাত মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই সময়ে ইউরোপের বাজারে ১১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ পোশাকপণ্য রপ্তানি হয়েছিল। সেখান থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ১৩ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের ১ হাজার ৩৭৩ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার পোশাকপণ্য গত সাত মাসে রপ্তানি হয়েছে। যা আগের বছরে ছিল ১ হাজার ১৯৪ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার ডলারে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে জার্মানিতে। দেশটিতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র শূন্য দশমিক ৮৩ শতাংশ বেড়ে পোশাকপণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এরপর স্পেন এবং ফ্রান্সেও রপ্তানি বেড়েছে যথাক্রমে ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং ১৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যান্য প্রধান ইইউ দেশ—যেমন ইতালিতে সাড়ে ৫৭ শতাংশ, অস্ট্রিয়াতে ৩২ দশমিক ৯৩ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসে ৩২ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং সুইডেনে পোশাকপণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। ইউরোপের পাশাপাশি রপ্তানি বেড়েছে যুক্তরাজ্য ও কানাডার বাজারে। এছাড়া পরিসংখ্যান মতে, যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং ১৯ দশমিক ২৫ শতাংশ।
বেশ কিছু সামাজিক সূচকের পাশাপাশি অর্থনীতির সূচকেও উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে বাংলাদেশ। এমডিজি সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে, এসডিজি বাস্তবায়নের পথে। সরকারের নানামুখী ইতিবাচক উদ্যোগের ফলেই দেশে রপ্তানি আয় বেড়েছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রবাসী আয়ও। পাশাপাশি বিলাসীপণ্য আমদানি বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে ডলার-সংকট। মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। রমজান মাসকে ঘিরে যে সংকটের কথা বলা হচ্ছিল তা আর থাকছে না। বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের যথেষ্ট মজুত আছে। প্রধানমন্ত্রী অযথা আতঙ্কিত হয়ে বেশি খাদ্যদ্রব্য মজুত না করার আহ্বান জানিয়েছেন। যখন যেটুকু প্রয়োজন, তখন সেটুকু ক্রয় করলে কোনো সমস্যা হবে না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির জন্য একটি দেশে সবচেয়ে দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে আরো ভালো করার সুযোগ রয়েছে। রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে তৈরি পোশাকের মতো সম্ভাবনাময় খাতে শুল্কসুবিধা দেওয়ার পরামর্শ তাদের।
লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়