এই পৃথিবীতে অপ্রয়োজনে কেহ অন্য কাহারো ভার বহন করিতে চাহে না। শীতকালে শুষ্কতার জন্য গাছও তাহার পাতা খসাইয়া ফেলে যাহাতে অতিরিক্ত রস ঐ পাতাসমূহ শুষিয়া না লয়। আবার যাহাকে প্রয়োজন হয়, তাহাকে যে কোনো মূল্যে ধরিয়া রাখা হয়। ইহা প্রকৃতির নিয়ম। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে আরব্য রজনির সিন্দবাদ ও এক বৃদ্ধের কাহিনি। সিন্দবাদ যখন জাহাজডুবির পর একটি দ্বীপে একা আশ্রয় গ্রহণ করেন, তখন একটা ছোট্ট জলপ্রপাতের সাঁকোর নিকট প্রায় উলঙ্গ একজন মানুষকে দেখিতে পান। সিন্দবাদ ভাবিলেন, তাহার মতোই করিত্কর্মা কেহ হইবে যিনি হয়তো জাহাজডুবির পর সর্বস্ব হারাইয়া ঐ দ্বীপে আটকা পড়িয়াছেন। লোকটি সিন্দবাদকে বুঝাইলেন, তাহার চলার শক্তি নাই। তিনি সিন্দবাদের কাঁধে উঠিয়া ঐ দ্বীপের একটি ঝরনার নিকট লইয়া যাইতে বলিলেন। তাহার খুব পানির তেষ্টা পাইয়াছে। সিন্দবাদ সমব্যথী হইয়া তাহাকে কাঁধে তুলিলেন। এবং তাহার পরে সিন্দবাদের কী অবস্থা হইয়াছিল, তাহা আমরা সকলেই জানি। ঐ লোকটি সিন্দবাদের কাঁধ হইতে কিছুতেই আর নামিতে চাহিল না। সিন্দবাদের কাঁধে উঠিয়া লৌহশক্ত হাতে তাহার গলা ঐ লোকটি এমনভাবে আঁকড়াইয়া রাখিল যে, সিন্দবাদ যেন দম বন্ধ হইয়াই মারা যাইবে। অতঃপর বিশেষ কৌশলে সেই লোকটিকে মারিয়া তাহার ভার হইতে মুক্ত হইতে হইল সিন্দবাদকে।
ইহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, এই পৃথিবীতে অপ্রয়োজনে কিংবা নিজেকে বিপদে ফালাইয়া কেহ কাহারো ভার বহন করিতে চাহে না। কী চাকরি, কী ব্যবসায়-বাণিজ্য, কী সমাজসংসার—সকল স্থানেই নিজেকে প্রয়োজনীয় হিসাবে প্রমাণ করিতেই হয়। যিনি নিজেকে প্রয়োজনীয় বলিয়া প্রমাণ করিতে পারেন না তিনি অপাঙক্তেয় হইয়া পড়েন। সুতরাং আপনি যে অপরিহার্য তাহা নিজেকেই প্রমাণ করিতে হইবে। আর এই প্রমাণের সবচাইতে বড় উপায় হইল—নিজের কাজ নিজে যথাযথভাবে করা। মার্টিন লুথার কিংয়ের একটি উক্তি আমরা এই ক্ষেত্রে স্মরণ করিতে পারি—‘আমরা প্রত্যেকে এক অপরিহার্য সমঝোতার জালে জড়াইয়া আছি, যাহার প্রতিটি সুতা একটি আরেকটির সহিত জুড়িয়া আছে।’ আসলে এইখানে অপরিহার্যতা। যদি সেই সমঝোতা ও কাজের সুতা ছিঁড়িয়া যায়, তাহা হইলে আর অপরিহার্যতা থাকে না। আবার এই রকমও আছে যে, অনেকে নিজেকে জোর করিয়া অপরিহার্য বলিয়া মনে করেন; কিন্তু বিচক্ষণ ব্যক্তি কখনো তাহা ভাবিতে পারেন না। একজন উঠতি খেলোয়াড় কোচের নিকট আক্ষেপ করিতেছিলেন যে, সংবাদমাধ্যম তাহাকে গুরুত্ব দেয় না। কোচ বলিয়াছিলেন, ‘সর্বাগ্রে দারুণ পারফর্ম করিতে হইবে। সাংবাদিকরা তখনই আপনাকে লইয়া লিখিবেন।’
সুতরাং বর্তমান এই প্রতিযোগিতাপূর্ণ সময়ে নিজের দক্ষতা প্রমাণের কোনো বিকল্প নাই। সময়ের সহিত তাল মিলাইতে হইলে একজন পেশাজীবীকে অবিরাম যোগ্যতা, দক্ষতা ও কর্মতত্পরতা বাড়াইতে হয়। সময়ের পরিবর্তন হইতেছে, চাহিদারও পরিবর্তন হইতেছে, পেশাগত দক্ষতার প্রয়োজনীয়তারও পরিবর্তন হইতেছে। আর শেষ কথা হইল—বৃক্ষের পরিচয় তাহার ফলে। একজন অযোগ্য ব্যক্তি যত পরিকল্পনাই করুন না কেন, যত সুযোগসন্ধানীই হউন না কেন, যদি শেষ পর্যন্ত তিনি অযোগ্য ও অদক্ষ থাকেন, তাহার ছাপ তাহার কর্মফলে পড়িবেই। সুতরাং নিজেকে প্রকৃত দক্ষ করিয়া গড়িয়া তুলিবারও বিকল্প নাই। আর বিকল্প নাই পরিশ্রমের। কেহ যদি নিরলস কর্মঠ হন তাহ হইলে তাহার মূল্যায়ন হইবেই। সূর্য উঠিলে যেমন জগতের সকল কিছু আলোকিত হইয়া যায়, দক্ষতাও তেমনি আলোর মতো ছড়াইয়া পড়ে। অতএব সার্বিকভাবে নিজেকে যোগ্য ও কর্মতত্পর করিবার মাধ্যমে অপরিহার্য করিতে হয়। নচেৎ অযোগ্য অপ্রয়োজনীয় লোকের ভার সিন্দবাদের মতো কেহই বহন করিবে না। ইহাই এই জগতের বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করিলে তাহাতে অযোগ্য ব্যক্তির যেমন ক্ষতি, তেমনি ক্ষতি প্রতিষ্ঠানেরও। অন্ধ থাকিলে তো প্রলয় বন্ধ হইবে না।