রোববার, ১১ জুন ২০২৩, ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
দৈনিক ইত্তেফাক

ইরানের প্রাচীন ঐতিহ্য নওরোজ

আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৩, ০০:৫৪

ঈদে নওরোজ, ইরানি সংস্কৃতির একটি প্রাচীন ঐতিহ্য ও আচার অনুষ্ঠান, যা কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। তবে এই আচার অনুষ্ঠানটি এত দীর্ঘকালের পুরোনো হলেও কোনো বিস্মৃতি  বা বার্ধক্যের ছাপ এর চেহারায় দেখা যায় না। বরং এটি এখনো আনন্দ, নতুনত্ব ও পুনরুজ্জীবনের বার্তাবাহক। ইতিহাস জুড়ে নওরোজের দীর্ঘায়ু ও টেকসই হওয়ার রহস্যও নিহিত রয়েছে এই আনন্দ ও নতুনত্বের বার্তার মধ্যে, যা  মানবের আত্মা ও সহজাত প্রবৃত্তির সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে আছে এবং গৌরবময় এই ঐতিহ্যকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে।

নওরোজ হলো ঋতুরাজ বসন্তের সূচনা এবং প্রকৃতির পুনরুজ্জীবন। সতেজতা ও নতুনত্বের প্রতি মানুষের যেহেতু একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ রয়েছে, তাই  বসন্ত ও প্রকৃতির সতেজতা মানুষের অস্তিত্বে সতেজতা ও পুনরুজ্জীবনের প্রেরণা জোগায়। এ কারণেই বসন্তের আগমন  এবং নওরোজের  এই  সৌন্দর্য ও মোহনীয়তা সর্বদা ইরানিদের যেমন আকৃষ্ট করছে, তেমনি ফারসি কাব্য-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রেখে চলেছে বিশেষ অবদান। বার্তাবাহী ও অনুপ্রেরণাদায়ক নওরোজ বিভিন্ন দিক থেকে ফারসি সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত ও মহান ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং বলা যেতে পারে সব ফারসি কবি ও সাহিত্যিক প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন ও বার্তাবাহী ও প্রেরণাদায়ক নওরোজকে তাদের লেখনীতে ও সাহিত্যকর্মে তুলে ধরেছেন। তুস নগরীর বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক ফেরদৌসি তার শাহনামা কাব্যগ্রন্থের সিয়ভাস গল্পে সর্বকালের মানুষের জন্য নওরোজ বা নতুন দিন কামনা করে কাব্য রচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন—

প্রতি বছর তোমার ভাগ্যের হোক জয়

তোমার সারাটা জীবন হোক শুভ নওরোজ

এই কবিতায় নওরোজকে সুখ ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে মানুষের সারা জীবনের ও বছরের প্রতিটি দিনের  শুভকামনা করা হয়েছে। এটি অন্যের জন্য সৌভাগ্য কামনা করার রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। শেখ সাদিও নওরোজকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন এবং বলেছেন :

ভোরের স্নিগ্ধ সমীরণ নিয়ে এলো নওরোজের সুঘ্রাণ

আমার প্রিয়জনের জন্য তা নিয়ে আসুক সৌভাগ্যের বারতা

আশীর্বাদে পূর্ণ হোক তোমার এ বছর ও প্রতিটি বছর,

সমৃদ্ধ হোক তোমার আজকের এই দিন ও প্রতিটি দিন।

শেখ সাদি তার এই কবিতায় নওরোজের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে মানুষের প্রতিটি দিন নওরোজের মতো সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক—এই কামনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই কবিতায় নওরোজ সম্বন্ধে সাদির দৃষ্টিভঙ্গি কবি ফেরদৌসির  দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ এবং এই দিনটি একটি শুভ ও বরকতময় দিন হিসেবে মানুষের জীবনের প্রতিটি দিনের সমৃদ্ধি কামনা করা হয়েছে।

মৌলানা রুমি তার দেওয়ানে শামস-এ নওরোজ সম্পর্কে  জ্ঞানতাত্ত্বিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন এবং নওরোজকে সৃষ্টিকর্তার বাণীর নিদর্শন ও এমনকি খোদার অস্তিত্বের নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন।  তিনি তার কবিতার ছন্দমিল করেছেন মাতাল, প্রেম, তারুণ্য এবং আমাদের বন্ধু এই অভিধাগুলো দিয়ে। যার মাধমে তিনি মূলত নওরোজ ও বসন্তের সূচনাকে মেষ রাশির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বসন্ত ও প্রকৃতির নতুন প্রাণের সঞ্চারকে আল্লাহর প্রদত্ত বলে মনে করেন এবং বলেন,

টিউলিপ আর তুলসীর পাতাগুলো আজ পেল পানপেয়ালার আকৃতি

আমার রব ব্যতীত এমন অনন্য শোভার কারিগর আর কে হতে পারে?

কবিতার এই লাইন দুটির ধারাবাহিকতায় তিনি অপর দুটি চরণে বলেন,

লিলি ফুল বলল কানে গুল্মলতাটিরে

রবের ছায়া থেকে যেন না যাই কভু সরে।

নওরোজের অনুপ্রেরণা এবং বসন্তে প্রকৃতির পুনরুজ্জীবন মানুষের অন্তরকেও পুনরুজ্জীবিত করে। প্রকৃতির মতো নিজের দুঃখ ও ধূলিকণা দূর করে হৃদয় ও আত্মায় আলোর প্রদীপ জ্বালানোর আয়োজন করে। ফারসি কাব্যসাহিত্যে বসন্তের আগমন ও নওরোজের অন্যান্য বার্তার মধ্যেও রয়েছে কঠিন ও ক্লান্তিকর দিনগুলো কেটে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি। শীতকাল তার একটি রূপক। প্রতিটি কঠিন ও কষ্টকর সময়ের পর মানুষের জীবনে যেমন অপেক্ষা করে সুখ ও আনন্দময় দিনগুলি। এই দিক থেকে বলা যায়, নওরোজ আগামী দিনের আশার বার্তা নিয়ে আসে এবং মানুষকে আশাবাদী হতে আমন্ত্রণ জানায়।

ওপরের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে নওরোজ সম্পর্কে যেসব অর্থ ও ধারণা পাওয়া গেল, তা  ফারসি কাব্য সাহিত্যের মহান ব্যক্তিদের নওরোজ সম্পর্কে গভীর ধারণা ও অনুপ্রেরণার উদাহরণ। এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, বসন্তের আগমন এবং নওরোজ একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও  এর একটি ধর্মতাত্ত্বিক দিকও রয়েছে এবং এটি আল্লাহর নিদর্শনের একটি।

ঋতুরাজ বসন্ত এবং নওরোজের পরিপূর্ণ ধারণা নিতে বলা যায়, প্রাকৃতিক এই ঘটনাটি পুনরুত্থানের একটি অনুস্মারক এবং  প্রকৃতি যেমন শীতকালীন মৃত অবস্থা থেকে বসন্তে পুনরুজ্জীবিত হয়, মানুষও  তেমনি মহান আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবিত হবে এবং যে জীবনের কোনো শেষ নেই এবং এই জীবন অনন্তকালের (চিরন্তন )। মানুষের চিরন্তনতা সেটাই, যা মানুষের সত্তাকে অর্থপূর্ণ করে এবং তার জীবনকে উদ্দেশ্যপূর্ণ করে।

এই নিবন্ধের শেষ পর্যায়ে এসে এটি না বললেই নয় যে, নওরোজের প্রচলিত কিছু রীতিনীতি রয়েছে যেমন—ঘর ও আসবাবপত্র  পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা,  নতুন জামাকাপড় পরা, একে অপরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করা, উপহার ও ঈদি দেওয়া ইত্যাদি মানবিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করে এবং বন্ধুত্ব ও উদারতা বৃদ্ধি করে।

লেখক : কালচারাল কাউন্সেলর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস, ঢাকা

 

ইত্তেফাক/ইআ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন