দেশের ১৭টি পৌরসভার মেয়াদ শেষ হইলেও সেইগুলিতে নির্বাচন করার কোনো আয়োজন দেখা যাইতেছে না। আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের আয়োজন করিয়া থাকে; কিন্তু এই সকল পৌরসভার ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা না থাকায় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের আয়োজন করিতে পরিতেছে না। আর ইহারই সুবাধে মেয়াদ বাড়াইয়া বাড়াইয়া প্রশাসকরা পৌরসভা পরিচালনা করিতেছেন। নিয়মানুযায়ী ১৮০ দিনের অধিক একজন প্রশাসক ক্ষমতায় থাকিতে পারেন না। তাই ব্যক্তির বদল ঘটাইয়া প্রশাসক বসাইয়া রাখা হইতেছে।
পৌরসভায় মেয়াদ শেষ হইলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অতিরিক্ত সময়ের এক দিনও ক্ষমতায় থাকিতে পারিবেন না বলিয়া আইন পাশ করা হইয়াছে; কিন্তু অনির্বাচিতরা যত দিন খুশি ক্ষমতায় থাকিতে পারিবেন—এই নজির বিশ্বে কোথাও না থাকিলেও বাংলাদেশ তাহার ব্যতিক্রম। ইহা বৈপরীত্যপূর্ণও বটে। দেখা যাইতেছে, দেশের অন্তত ১৭টি পৌরসভায় নির্বাচিত প্রতিনিধির মেয়াদ শেষে তাহাদের সরিয়ে অনির্বাচিত প্রতিনিধি লইয়া পৌরসভা পরিচালিত হইতেছে। এই সকল পৌরসভায় ক্ষেত্রবিশেষ সরকারি কর্মকর্তার পাশাপাশি দলীয় রাজনীতিকদের বসানো হইয়াছে। বলা হইতেছে বিভিন্ন ধরনের মামলা-মোকদ্দমার জটিলতায় এই সকল পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যাইতেছে না। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও মামলা করিয়া মেয়াদ শেষেও ক্ষমতায় থাকিতেন বলিয়া তাহাদের সরাইবার উদ্দেশ্যে আইন করা হইল; কিন্তু অনির্বাচিতরা এখন কীভাবে সেই একই অস্ত্র ব্যবহার করিয়া ক্ষমতা ভোগ করিতেছেন—সেই প্রশ্ন কি অবান্তর হইবে? যেইখানে মেয়াদ ঠিক রাখিয়া সিটি করপোরেশন, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হইতেছে বা নির্বাচনের আয়োজন করা হইতেছে, সেইখানে নির্ধারিত কিছু পৌরসভার ক্ষেত্রে নির্বাচন লইয়া এই টালবাহানার নানা প্রশ্নের জন্ম দিতেছে। এই অবস্থা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ অব্যাহত রাখিবার ক্ষেত্রে সহায়ক নহে তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। সামগ্রিক বিষয়টির যথার্থ বিচার করিয়া সঠিক তদন্ত হওয়া জরুরি। নির্বাচন ছাড়া রাজনীতি ও গণতন্ত্র টিকসই হইতে পারে না তাহা বোধ করি বুঝিবার জন্য বিশেষ বোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নাই। সামান্য রাজনীতি-সচেতন যে কেউই বলিতে পারেন রাজনীতির জন্য নির্বাচন কতটা অপরিহার্য। সর্বত্র নির্বাচনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখিতে না পারিলে এই প্রশ্নও উঠিবে যে, ক্ষমতায় থাকিয়া রাজনীতিক বা জনপ্রতিনিধিরাই কি অপরাধ করিতেছেন? কয়েক যুগ ধরিয়া দেশের সকল ক্ষেত্রে যখন বিরাজনীতিকরণের অপচেষ্টা চলিয়া আসিতেছে, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলে সেই অপচেষ্টা কিছুটা হইলেও রাশ টানিয়া ধরিতে সক্ষম হইতেছে। এই ধারা আরো মজবুত করিয়া সামনের দিকে আগাইয়া লইয়া যাওয়াই হইবে স্বাধীন দেশের মূল লক্ষ্য। পৌরসভাগুলিতে নির্বাচন না করিতে পারা বা না করার ক্ষেত্রে যুক্তি বা অযুক্তির প্রশ্নও বিবেচনার দাবি রাখে।
পৌরসভাগুলিতে অনির্বাচিত ও অরাজনীতিকদের বসাইয়া রাখিয়া কি সেই বিরাজনীতিকরণের ধারাকেই প্রতিষ্ঠিত করিবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হইতেছে না? এই প্রশ্ন রাখিয়া বিজ্ঞজনেরা বলিতেছেন, যদি মামলা-মোকদ্দমার কারণেই নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব না হয়, তাহা হইলে সেই মামলা নিষ্পত্তির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের যথার্থ উদ্যোগ পরিলক্ষিত হইত। দ্রুত যদি অনির্বাচিত ব্যক্তিদের সরাইবার জন্য রাজনীতিকদের ক্ষমতা ফিরাইয়া দেওয়ার সুযোগ তৈরি করা না হয়, তাহা হইলে এই ধারা যে অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হইবে তাহা বলাই বাহুল্য। মনে রাখিতে হইবে পৌর নির্বাচন রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। সুতরাং এই বিষয় যদি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট হস্তান্তর করা যায়, তাহা হইলে সরকার ও স্থানীয় জনগণ উভয়ের জন্য স্বস্তিদায়ক হইবে।